
বন্দর নগরীর পান্না পাড়া শেল্টারে নিরবে নিভৃতে চলছে এক কর্মযজ্ঞ। অবশ্য এটাকে কর্মযজ্ঞ না বলে বলা যায় বিশাল কর্মযজ্ঞ ঘটাবার প্রাথমিক প্রস্তুতি। তৈরি করা হচ্ছে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক (হাই পাওয়ার এক্সপ্লোসিভ)। গোপন এক কক্ষে বসে সকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন দুই নগর গেরিলা যোদ্ধা, জাফর উল্লাহ বোরহান এবং ফয়জুর রহমান ফকির। কাজটা বিপদজনক হলেও এই কাজে দুই যোদ্ধা মোটামুটি হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। দুই জনই ভারত থেকে বিস্ফোরকের উপর বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট গেরিলা যোদ্ধা। একাধিক অপারেশনও করে ফেলেছেন এর মধ্যে। তাই বিশেষ বেগ পাওয়া ছাড়া সন্ধ্যার আগেই তৈরি করে ফেললেন ২০ পাউন্ডের পি ই কে এক্সপ্লোসিভ।
বলে নেয়া ভালো Explosive/ Dynamite/ বিস্ফোরক/ বারুদ সব একই জিনিস। এক্সপ্লোসিভ ২ ভাগে বিভক্ত, হাই এক্সপ্লোসিভ এবং লো এক্সপ্লোসিভ। মুক্তিযোদ্ধারা মূলত তিন ধরনের হাই এক্সপ্লোসিভ ব্যাবহার করতেন।
১. টি এন টি স্লেব।
২. জি ই সি স্রেব।
৩. পি ই কে স্লেব।
এক্সপ্লোসিভের কাজ হলো শত্রু পক্ষের যে কোন টাগের্ট বিস্ফোরণ (Blust) ঘটিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া। তবে এ কাজে লেখা-পড়া এবং অংক জানা থাকতে হবে। কোন জিনিস ধ্বংস করতে কত পাউন্ড বারুদ লাগবে, তা অংকের সূত্রের মত হিসাব করে বের করতে হয়। ব্রিজ উড়াতে, বিল্ডিং উড়াতে, কালভার্ট উড়াতে, ইলেকট্রিক টাওয়ার উড়াতে এবং আরো বিভিন্ন টাগের্ট উড়াতে বিভিন্ন হিসাব। আজকে গেরিলাদের টার্গেট আগ্রাবাদ ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনের ওয়ারলেস সেট। যেটি দোতলা বিল্ডিংয়ের একটি রুমে অবস্থিত। বোমাটি বানানো হয়েছে দ্রুততম সময়ে বোমা বানানোর সরল পদ্ধতি (Hasty Method) অনুসরণ করে। এই পদ্ধতিতে রুমের সর্বমোট ঘনফুটকে পঞ্চাশ দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা বা রাশিফল পাওয়া যায় সেটাকে পাউন্ড ধরে সে পরিমাণ বিস্ফোরক দিয়ে বোমা বানালে সেটা হবে ওই রুম ধ্বংসের উপযোগী কনকাশন বোমা।
যেমন ধরা যাক রুমের দৈর্ঘ্য১৫'×প্রস্থ১২'×উচ্চতা১২'= ১৮০০ ঘনফুট।
তাহলে রুম উড়াতে দরকার ১৮০০÷৫০= ৩৬পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ।
আজকের অপারেশনে ব্যবহার করা হবে ২০ পাউন্ড ভারতীয় পি ই কে এক্সপ্লোসিভ। বিল্ডিং ওড়ানো শুনতে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে তত সোজা নয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবগুলো কাজ নিখুঁত দক্ষতায় শেষ করতে পারলেই কেবল ঘটবে বিস্ফোরণ। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টকে সশরীরে যেয়ে বিল্ডিংয়ের ভেতর চার্জ বসাতে হবে৷
চার্জ মানে এক্সপ্লোসিভের স্তুপ। বিল্ডিংটি ধ্বংস করতে কি পরিমাণ বারুদ লাগবে তা আগেই হিসাব করে নিতে হবে। প্রতিটি চার্জে করডেক্সের তার যুক্ত করতে হবে। করডেক্সের তার প্রতি সেকেন্ডে ২০,০০০ ফিট জ্বলে বা শক্তি বহন করে।
চার্জ বসিয়ে করডেক্সের তারের লাইন নিয়ে আসতে হবে সুবিধামত স্থানে। সংযোগ করতে হবে ডিটোনেটরের সাথে। ডিটোনেটার, যা হাই এক্সপ্লোসিভ এবং লো এক্সপ্লোসিভ এর মধ্যে সংযোগ এবং সংঘর্ষ ঘটায়।
ডিটোনেটারের ভরা অংশের সাথে করডেক্সের তার লাগাতে হবে। এমনিতেই ডিটোনেটারের অর্ধেক খালি থাকে, খালি অংশে সেফটি ফিউজ ঢুকিয়ে দিতে হয়। সেফটি ফিউজ বা নিরাপত্তা ফিউজ, যা প্রতি মিনিটে ২ ফুট জ্বলে। এর নামই বলে দেয় এর কি কাজ। এটা দ্বারা সময় নির্ধারন করা হয়। যাকে টাইম বম্বও বলা হয়ে থাকে। চার্জ বসাতে যাওয়া গেরিলাদের বাঁচানোর জন্য এটা কাজ করে। যেমন একটি গ্রেনেডে সাধারণত ৪ সেকেন্ডের সেফটি ফিউজ দেওয়া হয়। যা গ্রেনেড নিক্ষেপকারীকে সেফ করে। গ্রেনেড নিক্ষেপের পর নিক্ষেপকারী চার সেকেন্ড সময় পায় নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে। তেমনিভাবে গেরিলাদের নিরাপত্তার জন্য যতটুকু সময় লাগবে, তা হিসাব করে সেফটি ফিউজ দিতে হবে।
সেফটি ফিউজের বাকী মাথা পেন্সিল কাটার সময় যে ভাবে তোলানো হয়, সেই ভাবে তোলাতে হবে। সেফটি ফিউজটি এংগেলে অর্ধেক কাটা হবে। কাটা এংগেলে ম্যাচের কাঠি রেখে, ম্যাচ বক্সের বারুদ লাগানো অংশে ঘষা দিতে হবে। এখানে ম্যাচের এই কাঠিটিকেই লো এক্সপ্লোসিভ বলা হয়। কাঠির সাথে সেফটি ফিউজও হিস হিস শব্দ করে জ্বলা আরম্ভ করবে। ছোট ছেলেমেয়েরা তারাবাতি জ্বালিয়ে যেভাবে খেলা করে, এটিও আলো ছড়িয়ে হিস হিস শব্দ করে জ্বলা শেষ হওয়া মাত্রই বিকট শব্দ করে সমস্ত চার্জ একত্রে বিস্ফোরন ঘটাবে। পুরো বিষয়টা একটার পর একটা সাজালে দাঁড়ায়,
ম্যাচের কাঠি==> সেফটি ফিউজ + ডেটনেটরের খালি অংশ==> ডেটনেটরের ভরা অংশ==> [লো এক্সপ্লোসিভ + হাই এক্সপ্লোসিভ]==> করডেক্সের তার==> এক্সপ্লোসিভের স্তুপ এবং বুম……….
এতসব কাজ করার জন্য এই দুই গেরিলার লাগবে সেফ পেসেজ। সেফ পেসেজ তৈরী করবে অন্যান্য গেরিলারা।
সেদিকে যাওয়ার আগে বলি কেন দেওয়ানহাট ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনটিকে আজকে টার্গেট করা হয়েছে। স্টেশনে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন (হাই ফ্রিকোয়েন্সী) ওয়ারলেস সেট আছে। যার সাহায্যে অত্র এলাকায় গেরিলা মুভমেন্ট হলেই যোগাযোগ করা হতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে। ফলে আশেপাশে গেরিলাদের অপারেশন হলেই আর্মি দ্রুত খবর পেয়ে উপস্থিত হতে পারতো। মুল উদ্দেশ্য এই যোগাযোগ মাধ্যমটা নস্ট করা। তখন চলছে নভেম্বর মাসের শেষ দিক। যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী দেশে ঢোকার মুখে। এই অবস্থায় ১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশও এসে পৌছায় নগরে যত ওয়ারলেস সেট আছে সব ধবংস করার জন্য। যাতে সামগ্রিক যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান আর্মি কমিউনিকেশন গ্যাপের মধ্যে পড়ে।
পাকবাহিনীর কাছে এই স্টেশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটিতে বড়সড় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধবংস করার সাথে সাথেই আর্মির পেট্রোল এখানে চলে আসবে। এরাই সেকেন্ডারি টার্গেট। এদের জন্য পেতে রাখা হবে এম্বুশ। বিস্ফোরণটা ফলস এলার্মের কাজ করবে। ডেকে আনবে শত্রুকে গেরিলাদের পেতে রাখা ফাদের দিকে। ঠিক যেমন বরশিতে বাধা কেচো, মাছকে আকর্ষন করে বড়শি গিলতে। এটাই গেরিলা টেকনিক রেইড এন্ড এম্বুশ।
সিদ্ধান্ত হল এই অপারেশন বি এল এফ এবং এফ এফ যৌথভাবে করবে। বি এল এফ এর কেসি-১,২,৩ এবং এফ এফের কয়েকটি গ্রুপ সাথে লোকমান গনির গ্রুপ। বি এল এফ এর নেতৃত্বে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল হারুন (হারুন আংকেল) এবং এফ এফ এর গ্রুপের নেতৃত্ব দেয়া হল লোকমান গনিকে (কিলার লোকমান)।
করা হলো ব্যাটল প্ল্যান। বি এল এফ এবং এফ এফকে মিলিয়ে প্রায় ৩০ জনের পুরো দলটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হলো।
১ম দলের নেতৃত্বে থাকবেন লোকমান গনি। তারা প্রথমে পজিশন নিবে দেওয়ানহাট মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমকোণে মীরবাড়ির কবরস্থানে।
২য় দল চৌমুহনী কর্নফুলি মার্কেটের পাশে পজিশন নিবে। এ দলের নেতৃত্বে থাকবেন ইঞ্জিনিয়ার হারুন।
যদি বিস্ফোরণের পর আর্মি পেট্রোল আগ্রাবাদের দিক থেকে আসে তাহলে এম্বুশ করবে কর্নফুলি মার্কেটের পাশে পজিশন নেয়া ২য় দল। শত্রু এম্বুশে পড়ার পর যদি দেওয়ান হাটের দিক থেকে পাক আর্মির কোন বেক আপ টিম আসে তাহলে তাদের কাভার দিবে কবর স্থানে পজিশন নেয়া ১ম দল।
আর যদি বিস্ফোরণের পর আর্মি পেট্রোল দেওয়ানহাটের দিক থেকে আসে তবে এম্বুশ করবে ১ম দল এবং তাদেরকে কাভার দিবে ২য় দল যাতে আগ্রাবাদের দিক থেকে কোন সাপোর্টিং পাকিস্থান ফোর্স আসতে না পারে।
দুই গ্রুপের কাছেই একটা করে এল এম জি এবং সদস্যদের প্রত্যেকের হাতে এস এল আর অথবা এস এম জি। এম্বুশের জন্য পর্যাপ্ত ফায়ার পাওয়ার সাথে লোকবল এবং লোভনীয় টার্গেট।
আর দুই এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টকে সাথে নিয়ে ৩য় দল যাবে বিস্ফোরণ স্থাপন করতে। এই দলের সদস্য চার জন। দুই এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট জাফর উল্লাহ বোরহান এবং ফয়জুর রহমান ফকির, তাদেরকে কাভার দিয়ে সেফ প্যাসেজ করে দিবে আরো দুই নগর গেরিলা আমল মিত্র (অমল আংকেল) এবং ফজলুল হক ভূইয়া (আমার বাবা)।
সময় তখন প্রায় রাত ১২টা কি ১টা। ১ম দল এবং ২য় দল যথারীতি পজিশনে। আগ্রাবাদ ফায়ার ব্রিগেডের বিপরীত সাইডে এক্সপ্লোসিভ সহ এসে পজিশন নিলেন দুই এক্সপার্ট। পাশে দুই গেরিলা অমল মিত্র এবং ফজলুল হক। দুইজনের হাতেই ভারতীয় স্টারলিং এস এম জি(সাব মেশিন গান)। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অপর পারে অবস্থিত স্টেশনের দিকে। ফায়ার ব্রিগেডের দুটি গাড়ি দাঁড়ানো রাস্তার পাশদিয়ে সরাসরি চলে যাওয়া পার্কিং এরিয়াতে(এখন যেমন থাকে)। তিনজন আর্মস গার্ড আছে পাহারায়। আর কোন নড়াচড়া নাই আশেপাশে। পরস্পরের দিকে একবার তাকালেন দুই গেরিলা। চোখের ইশারায় যেন সিগনাল বিনিময় করলেন। মুহুর্তেই হাতের এস এম জি কক্ করে নিচু হয়ে শুরু করলেন দৌড়। তিনজন গার্ড হঠাৎ প্রায় একসাথে দেখলো সুনসান নিরব কুয়াশা ঢাকা রাতের রাস্তা চিড়ে আধার ফুড়ে যেন বেরিয়ে সামনে এসে দাড়ালো দুই যমদূত। হাতে উদ্যত স্টারলিং এর জালি জালি নলদুটি চেয়ে আছে তাদের দিকে। কানে বাড়ি খেলো বাজখাঁই চাপা হুংকার, "হ্যান্ডস আপ।"
বলার অবশ্য দরকার ছিল না। হাতের অনৈচ্ছিক পেশীগুলো যেন তৈরীই ছিল মাথার উপরে উঠে যাওয়ার জন্য। তিন গার্ড অস্ত্র ফেলে হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছে৷ ইশারায় তাদের ভেতরে যেতে বললেন গেরিলারা। পার্কিং এর ভেতরে দাঁড়ানো দুটি গাড়ির পেছনে নিয়ে তাদের দাড় করানো হলো। পাহারায় থাকলেন অস্ত্র হাতে ফজলুল হক। অমল মিত্র এক দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উঠে গেলেন দোতলায়। কিছুক্ষন পর সেখান থেকে সাব মেশিনের নলের মুখে নামিয়ে আনলেন দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তাকে। সমানে চোস্ত উর্দুতে গালি গালাজ করতে করতে ধাক্কা দিয়ে তাকেও লাইনে দাড় করালেন। তার গালাগালি আর হুমকি-ধামকি সাথে পান্ডুর মুখের কর্মকর্তাকে দেখে বন্দি গার্ডরা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি যে এই কর্মকর্তাই মুক্তিবাহিনীর গোপন সোর্স। এই লোকই গেরিলা কমান্ডার মৌলভী সৈয়দের আর্মস-ইন-কমান্ড ইঞ্জিনিয়ার হারুনকে ওয়ারলেসের অবস্থান এবং বিল্ডিংয়ের পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করেছিল। চারজনকে এক লাইনে দাড় করিয়ে অপর পারে থাকা এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টদের ইশারা করলেন ফজলুল হক। দৌড়ে এলেন জাফর উল্লাহ এবং ফয়জুর রহমান। সাথে জন্মদিনের কেক আকৃতির হাই পাওয়ারি পি ই কে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। ফায়ার ব্রিগেড ভবনের যে অংশে টাওয়ার আছে সে অংশের নিচতলায় রয়েছে একটি রুম। রুমটিতে অনেকগুলো প্যানেলবোর্ড। দেখেই বোঝা যায় রুমটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দরজা খোলা থাকায় অমল মিত্রের কাভারিং নিয়ে ফয়েজ ও বোরহান প্রবেশ করেন রুমে। সেখানের দায়িত্বে একজন কর্মচারী ডিউটিতে ছিলেন।
অস্ত্র হাতে অমল মিত্রকে ঢুকতে দেখে সেও হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচন্ড এক ধমক সাথে পর্যাপ্ত পরিমান উর্দু গালি খেয়ে সেও চোখের পলকে রুম ত্যাগ করলো। রুম থেকে বেরিয়েই পড়লো ফজলুল হকের সাব মেশিন গানের আগায়। আরেক প্রস্থ ধমকে তাকেও লাইনে দাড় করালেন।
এক্সপার্টরা লেগে পরলেন এক্সপ্লোসিভ লাগানোর কাজে।
পার্কিং এর পেছনেই রয়েছে ব্যারাক। কয়েকজন ফায়ার ব্রিগেড কর্মী সেখানে ঘুমাচ্ছে। বিস্ফোরণ হলে এত কাছে অবস্থিত ব্যারাক ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ আহত হতে পারে ঘুমন্ত বাঙালি কর্মীরা। তাদের সরানো উচিত। লাথি দিয়ে ব্যারাকের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন অস্ত্র হাতে ফজলুল হক। সমানে উর্দুতে গালাগালি করতে করতে তাদের ঘুম ভাঙালেন। পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনীতেই বড় হয়েছেন। আশে পাশে প্রচুর বিহারি বসতি ছিল৷ তাই ছোট থেকেই ভালো উর্দু বলতে পারতেন। তার চোস্ত উর্দু আর ফর্সা গায়ের রং দেখে পাকিস্তান আর্মিও অতীতে তাকে কয়েকবার বিহারি মনে করে ছেড়ে দিয়েছিল। কর্মচারীরা ঘুম থেকে উঠে অস্ত্র হাতে উর্দু ভাষী যুবক দেখে এমনিতেই হতভম্ব৷ গেরিলারা নিজেদের সাথে কথাও বলছেন উর্দুতে। যাতে সবাই মনে করে তারা রাজাকার বা বিহারি। এতে করে বন্দীদের মনে ধারণা হবে ভুল বুঝে কিছু বিহারি যুবক তাদের বন্দী করেছে। তাই তারা প্রথমে বোঝাতে চেস্টা করলেও ধমক আর গালির তোড়ে চুপ চাপ কথা শুনতে লাগলো। তারা ধারণা করলো ভুল ভেঙ্গে গেলেই বিহারি যুবকরা তাদের ছেড়ে দিবে সুতরাং অহেতুক ঝামেলা পাকিয়ে লাভ নেই।
বন্দী সবাইকে (প্রায় ১৫/১৬ জন) ব্যারাক থেকে বের করে দুই গেরিলা অস্ত্রের মুখে নিয়ে যান ফায়ার ব্রিগেড বিল্ডিংয়ের উত্তরদিকে আ্যাপার্টমেন্টের আড়ালে। উত্তর সীমানা প্রাচীরের পাশ ঘেষা খোলা জায়গায় নীল ডাউন করিয়ে রাখলেন সবাইকে। অস্ত্র হাতে বন্দীদের নির্দেশ দিলেন এই জায়গা থেকে না নড়তে। গেরিলারা বিল্ডিং ব্লাস্ট করবেন। তাই তারা এখান থেকে নড়লে বিস্ফোরণের তোড়ে নিজেরাই নিহত হতে পারেন। সবাই বিনা বাক্যে আদেশ মেনে বসে রইলো। এর মধ্যে বিস্ফোরক সেট করে রুমের সব জানালা বন্ধ করে দিলেন দুই এক্সপার্ট। কনকাশন বোমা রুমের মাঝখানে স্থাপন করতে হয়। বিস্ফোরণের আগে দরোজা জানালা বন্ধ করে দিলে শতভাগ কার্যকারীতা পাওয়া যায়। তাই ফিউজে আগুন দিয়েই দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দ্রুত নেমে আসেন দুই জন। নিচে নেমে হাতের ইশারায় কাভারে থাকা দুই গেরিলাকে কাজ শেষ হওয়ার জানান দিয়ে পালাতে বলেন। চারজন দৌড়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে অর্ধেক রাস্তা পার হতেই পেছনে হয় প্রচন্ড বিস্ফোরণ।
বিস্ফোরণের ধাক্কায় অয়্যারলেস টাওয়ারের ছোট ছোট অসংখ্যা ধ্বংসকণা শিলাবৃষ্টির মতো শব্দ তুলে সীমানা প্রাচীরের গায়ে আছড়ে পড়ে। পুরো বিল্ডিংয়ের এক অংশ ধ্বসে পড়ে গেছে।
চট্টগ্রাম শহরের গেরিলা যুদ্ধে এত বেশি ওজনের বোমা অন্য কোনো অপারেশনে এর আগে ব্যবহৃত হয়নি। প্রচন্ড কানফাটা আওয়াজে জেগে উঠলো ঘুমন্ত নগরী।
ওদিকে এমবুশ পেতে রাখা ১ম গ্রুপ, লোকমান গ্রুপে দুইজন নতুন ট্রেইন্ড অনভিজ্ঞ গেরিলা সদস্য ছিল। তারা এর আগে এত বিকট বিস্ফোরণের শব্দ কখনো শুনেন নি। শব্দের প্রচন্ড ওয়েভ তীব্র নাড়া দিল স্নায়ুতে। চমকে উঠে কক্ করা হাতের এস এল আরের ট্রিগারে চাপ পরে গুলি বেরিয়ে গেলো। ব্যাস আর যায় কই? পর পর দুটি ফায়ারের শব্দ শুনে অন্য গেরিলারাও ওপেন করলেন ফায়ার। স্বাভাবিক ভাবে সবাই ভেবে নিয়েছেন শত্রু আক্রমণ করেছে। যে যেদিকে পারছেন অন্ধকারে কাল্পনিক শত্রুর উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ছেন পাগলের মত। ১ম গ্রুপের প্রচন্ড গুলির শব্দে উত্তেজিত হয়ে ২য় গ্রুপও পালটা জবাব দিতে থাকে এলোপাথাড়ি। কিন্তু কোথায় শত্রু!! ফিরতি কোন ফায়ারই তো আসছে না। ভুল বুঝতে পেরে ফায়ার বন্ধ করার আদেশ দিলেন দুই দলনেতা। দুই গ্রুপ আবার ফায়ার বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে। আশা করছে, ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মিলিটারিরা নিকটস্থ লালখান বাজার গ্যারিসন থেকে এগিয়ে আসবে। কিন্তু না। তাদেরকে হতাশ করে কেউ এলো না।
এই অপারেশনে সেকেন্ডারি টার্গেট ছিল বিস্ফোরণের শব্দে এগিয়ে আসা পাকিস্তান আর্মির পেট্রোল কার। কিন্তু তারা আসেনি। এতেই বোঝা যায় আমাদের গেরিলারা শেষের দিকে পাকিস্তান আর্মিকে আতঙ্কিত করে রাখতে বেশ ভালো ভাবেই সমর্থ হয়েছিলেন।
পাকিস্তান আর্মি নিজ ক্যাম্পের নিরাপত্তা ছেড়ে রাতে আর বেরই হল না। আরো কিছুক্ষন সেখানে অপেক্ষা করে রিট্রিটের নির্দেশ দিলেন দুই দলপতি।
নিয়মিত সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে শত্রুর কোন স্থাপনা ধ্বংস বা দখলেরব উদ্দেশ্যে হিট করার পর কোন কারনে সেটা করা না গেলে ধরে নেয়া হয় অপারেশন বিফল বা সাকসেসফুল হয় নি। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে অনেক উদ্দেশ্যের মাঝে একটা মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শত্রুর মনোবলে চিড় ধরানো। তাই কোন টার্গেটে হিট করলে টার্গেটের ধ্বংস হোক বা না হোক শত্রুর মনোবলে তার একটা নেগেটিভ প্রভাব পড়বেই পড়বে। তাই টার্গেট ফুল ফিল না হলেও চট করে কোন গেরিলা অপারেশনকে ব্যার্থ বলাটা নৈতিকভাবে ঠিক না। সেই হিসেবে সেকেন্ডারি টার্গেট না এলেও এই অপারেশনটিও আমাদের নগর গেরিলাদের করা একটি সফল অভিযান। প্রকাশ্যভাবে প্রধান রাস্তায় পাক বাহিনীকে এমবুশ করার পরিকল্পনা তৎকালীন চট্রগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ধিত মনোবলেরই প্রমান দেয়।
এ অপারেশনে আরো যারা অংশ নেন তারা ছিলেন আজিজ, মফিজ, গরীবুল্লাহ, জাহেদ, মুসলিম খান সহ কে সি-১, ২ ৩, ৪, লোকমান গ্রুপ এবং এফ এফ বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরা। সবার নামের তালিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।
তথ্যসূত্রঃ
১| মুক্তিযুদ্ধ গবেষনা ট্রাস্টের উদ্যোগে অমল মিত্র, ফজলুল হক ভুইয়া এবং ফয়জুর রহমান ফকিরের ভিডিও সাক্ষাৎকার।
গ্রন্থঃ
১| বাঙালির জাতিয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম- ডাঃ মাহফুজুর রহমান।
২| মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান, ১ম খন্ড- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত।
৩| মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর- জামাল উদ্দিন।
৪| চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধ- করিম আবদুল্লাহ।
ছবিঃ
১| গুগল ম্যাপে অপারেশানের স্থান।
এই অপারেশনে অংশগ্রহন করা মুক্তিযোদ্ধাদের সবার নাম এবং ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। হারুন আংকেল, অমল আংকেল এবং আমার বাবার ছবি পুর্বের অনেক পোস্টে দেয়া হয়েছে বলে এই পোস্টে আর দেই নি।
নাজমুল হক রাজিব
১৯ পৌষ ১৪২৮
[৩ ডিসেম্বর ২০২২]
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: