
"সব কিছু মেনে নেওয়ার অর্থাৎ আনুগত্যের নিয়মকানুন এসেছে ধর্মগ্রন্থ থেকে এবং মুক্তি বা স্বাধীনতার নিয়মকানুন এসেছে বিজ্ঞান বা মানুষের মন থেকে৷"
- ম্যাক্সিম গোর্কি
১৮৬৮ সালের ২৮শে মার্চ। রাশিয়ার এক ছোট্ট শহরে ম্যাক্সিম পেশকভ আর ভারিয়ার ঘর আলো করে আসলো তাদের প্রথম সন্তান। সন্তানের নাম রাখা হলো আলেক্সেই পেশকভ। হেসে-খেলে দিন ভালোই কাটলেও বিপত্তি আসলো ১৮৭১ এর গ্রীষ্মে। ম্যাক্সিম পেশকভ মারা গেলেন কলেরাতে। ম্যাক্সিমের বড় ছেলের বয়স তখন তিন-চারের বেশি নয়। বাবার মৃত্যু সেই ছেলের মনে দারুণ দাগ কেটেছিলো। বড় হয়ে আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে ছেলেটি লিখলো,
“ আমার স্মৃতিতে যে ঘটনা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তা হলো একটি বর্ষার দিন। সমাধিক্ষেত্রের একটা জনমানুষ বিহীন জায়গা আর আমি পিচ্ছিল মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি। পাশেই একটা গর্তে আমার বাবার কফিন নামানো হচ্ছে আর আমি তাকিয়ে দেখছি। গর্তটার তলায় বৃষ্টির জল জমেছে কিছু আর কিছু ব্যাঙ লাফালাফি করছে। হঠাৎ দুটো ব্যাঙ লাফিয়ে বাবার কফিনের উপর উঠে গেলো।’’
সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটিই বড় হয়ে সাহিত্য দিয়ে তুলেছিলো বিপ্লবের ঝড়। সেদিনের সেই আলেক্সেই পেশকভ আর কেউ নয়, মহান বিপ্লবী রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি। ‘গোর্কি’ নামটি তার নিজেরই রাখা। রাশিয়ান ভাষায় ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ হলো ‘বেজায় তেতো’। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, গোর্কি ছেলেবেলার তিক্ত অভিজ্ঞতারই ছায়া থেকে এই নামের উৎপত্তি।
একবার গোর্কিকে বলা হয়েছিল কেন লেখেন? জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে সহজ ভাষায় বলেছিলেন, মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে প্রবল করে তোলার জন্য।
আরও বলেছিলেন, কঠোর বাস্তবতা ও তার সকল প্রকার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলার সংগ্রামে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে লিপ্ত করার জন্য হাতে কলম তুলে নিয়েছেন। এ্যালেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ্ পেশকভ যে ম্যাক্সিম গোর্কি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার পেছনে প্রধান কারণ হলো, বাল্যকাল থেকেই তাকে অন্যায় অত্যাচারের বিভৎসতা এবং ব্যাভিচারের আগুনে দাউ দাউ করে দগ্ধ হতে হয়েছে। দগ্ধ হতে হতেই তিনি অর্জন করেন শিল্পী হবার মৌলিক অধিকার ও যোগ্যতা।
ম্যাক্সিম গোর্কিকে লেখা বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও মনীষী রম্যা রঁলার একটি চিঠির অংশবিশেষ
‘…এক শীতের ভাটার টানে আপনার আবির্ভাব, যখন মহাবিষুবের লক্ষ্যে সবে বসন্তের মৃদু পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই কাকতালীয় ঘটনাটি আপনার জীবনে গভীর অর্থবহ কারণ জীর্ণ-পুরাতন পৃথিবীতে জন্মেও নতুন বিশ্বের সঙ্কেত-ঝড়ে আপনি ক্রমবর্ধমান হয়েছেন। অতীত ও বর্তমান—দুই পৃথিবীর যোগসূত্রে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘ এক সেতুর মতো। আমি সেতুটিকে অভিনন্দন জানাই। এ সেতু আকাশচুম্বী। আমাদের নতুন প্রজন্ম যুগে যুগে শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ে এই সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকবে…।’
উনিশ বছর বয়সে, গোর্কি যখন কাজানে এক রুটি কারখানার শ্রমিক, লেনিনের নেতৃত্বে সেখানে এক ছাত্র-বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহ দমন করতে, ছাত্রদের ওপর আসুরিক বলে চড়াও হয় কাজানের রুটি-শ্রমিকরা, গোর্কি যাদের গভীর আস্থা নিয়ে বোঝাতেন সমাজ পরিবর্তনের কথা। গোর্কির আস্থাভাজন এই শ্রমিকরা যখন এই ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়, দুঃখে বেদনায় গোর্কি কাজাঙ্কা নদীর তীরে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন। সুখের বিষয়, গুলি তার ফুসফুস বিদ্ধ করতে পারে না এবং গোর্কিকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করলে, ঐ শ্রমিকরাই গভীর ভালোবাসা ও মমতা নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ায়। ঐসব শ্রমিকের মুখে গোর্কি লক্ষ করেন আগামী দিনের ইতিহাস। দেখতে পান সামাজিক পরিস্থিতি কেমনভাবে মানুষকে পশুত্বে পরিণত করে। সুতরাং জীবন-ধারার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এ অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুন কর্মে নিয়োজিত করে, জীবনের এই বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি স্থির থাকতে পারেন না, বাধ্য হন কলম ধরতে।
তাঁর সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর বাবা ম্যাক্সিম পেশকভের বিশেষ কোন অবদান না থাকলেও মা ভার্ভারা’র অবদানকে কোন অংশেই খাটো করে দেখা যাবে না। যদিও অল্প বয়সে তাঁকে রেখে তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাবার পর মার সঙ্গে এসে আশ্রয় নিলেন মামার বাড়ি নিজনি নভোগরোদ শহরে। কিছুদিন পর স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করেন। ইতোমধ্যে মা ভার্ভারা আরেকজনকে বিয়ে করেছেন। ভদ্রমহিলা তার চেয়ে দশ বছরের ছোট এক অপদার্থকে বিয়ে করেন। পরের বিয়ে মোটেও সুখের হয়নি। এর কিছুদনি পরেই তিনি ক্ষয়রোগে মারা গেলেন। হঠাৎ করে মা মারা যাওয়ায় তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ল দাদার ওপর। দাদামশাই আর গোর্কির দায়িত্বভার নিতে চাইলেন না। মায়ের শেষকৃত্যের কয়েকদিন পরেই তাঁকে ডেকে বললেন, ‘‘তোমাকে এভাবে গলায় মেডেলের মতো ঝুলিয়ে রাখব তা তো চলতে পারে না। এখানে আর তোমার জায়গা হবে না। এবার তোমার দুনিয়ার ঘাটে বেরুনোর সময় হয়েছে।’’
সেই থেকে শুরু হল গোর্কির সংগ্রামমুখর নতুন জীবন। দশ বছর বয়স থেকে বৃদ্ধ দাদীর হাত ধরে ভিক্ষে করেছেন তিনি। শোনা যায় ম্যাক্সিম গোর্কিকে কোনও এক পত্রিকা-সম্পাদক অনুরোধ করেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী লেখার জন্য। গোর্কি নাকি সেই অনুরোধ রেখেছিলেন এবং মাত্র এই ক’টি লাইন লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন:
বিষয়টা বেশ মজার সন্দেহ নেই। কিন্তু এর পিছনে একটা তিক্তরসের আভাস পাওয়া যায় না?
আমাদের কৈশোরে আমরা জেনে যাই দুই খণ্ডে লেখা ‘মা’ কী ভাবে বিপ্লবের আগমনি বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা রাশিয়ায়।
তাই হয়তো আলেক্সি মাক্সিমোভিচ পেশকভ নাম পালটে তিনি হয়ে গেলেন ম্যাক্সিম গোর্কি এবং আজও পর্যন্ত রয়েও গেলেন তা-ই। রুশ শব্দ ‘ম্যাক্সিম’-এর অর্থ তেতো। প্রসঙ্গত বলি, পূর্বকথিত সম্পাদক মশাই কবে কখন তাঁকে আত্মজীবনী লিখতে অনুরোধ করেছিলেন, জানা নেই। মনে হয় ১৯২৩ সালের আগে। কারণ ১৯১৩ সালে শুরু করে দশটি বছরের শেষে গোর্কি তাঁর তিন খণ্ডের আত্মজীবনী রচনা সম্পূর্ণ করেন। আর তাই নিয়ে তিন পর্বের একটি অসামান্য ছবি নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত রুশ চলচ্চিত্রকার মার্ক দনস্কয়— ‘চাইল্ডহুড অব গোর্কি’ (১৯৩৮), ‘মাই অ্যাপ্রেন্টিসশিপ’ (১৯৩৯) এবং ‘মাই ইউনিভার্সিটিজ’ (১৯৪০)। অনেকে এই চলচ্চিত্রত্রয়কে শ্রেষ্ঠ জীবনীচিত্র বলে স্বীকৃতিও দিয়েছেন।
সাড়া জাগানো মা পড়েইই পৃথিবীর কিশোররা বড় হতে শিখে।এই উপন্যাসের লেখক মাক্সিম গোর্কির জীবন উপন্যাসের মতোই। অবশ্য যারা তাঁর আত্মজৈবনিক ট্রিলজি পড়েছেন (আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে, পৃথিবীর পাঠশালায়), তারা জানেন গোর্কির ছেলেবেলা সম্পর্কে।
গোর্কির লেখার জীবনবোধ ও ক্ষুরধার রাশিয়ার জার শাসকদের বিচলিত করে তোলে। ১৯০১ সালে বিপ্লবী ছাত্রদের হত্যার প্রতিবাদে গোর্কি রচনা করলেন ‘ঝোড়ো পাখির গান’ নামের কবিতাটি। ‘ঝোড়ো পাখির গান’ হয়ে ওঠে বিপ্লবের মন্ত্র। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে প্রতিবাদের মুখে তাঁকে আবার ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় সরকার। ক্রমে গোর্কি হয়ে ওঠেন লেলিন আদর্শের কর্মী।
১৯০২ সালে লিখলেন নাটক লোয়ার ডেপথ (নীচুতলা)। এই নাটকের বাণী ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের সর্বত্র। তখন গোর্কির পরিচিতি রাশিয়ার সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি হয়ে ওঠেন ইউরোপের শাসিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
গ্রেফতার হবেন জানতে পেরে দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অবশেষে তিনি জার্মানি ও ফ্রান্স হয়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন এই মহান লেখকের জীবনাবসান ঘটে।
জীবনের প্রতি অনীহা ও তিক্ততা ১৯ বছর বয়সে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তে ধাবিত করে তাকে। তবে মৃত্যু তাকে ভর্ৎসনা করে দুই-দু’বার ফিরে গেছে। জমানো অর্থ দিয়ে একটি পুরনো পিস্তল কিনেছিলেন আত্মহত্যার জন্য। গুলিও করেছিলেন বুকে নল ঠেকিয়ে। যার সাহিত্যকর্মের জন্য বিশ্ব অপেক্ষায় তাকে কী মৃত্যু গ্রাস করতে পারে? গোর্কিকেও পারেনি। পুলিশ নদীর পাড় থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
একই সঙ্গে আরো একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয় তার জামার পকেট থেকে যেখানে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর সব দায়দায়িত্ব জার্মান কবি হাইন-এর। হৃদয়ের দন্তশূল তিনিই আবিষ্কার করেছেন…।’
ম্যাক্সিম গোর্কি আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে গেলে তাঁর এক বন্ধু রসিকতা করে বলেন, ‘কী হে, ঈশ্বরের কাছে তো প্রায় চলে গিয়েছিলে, তা তিনি কী বললেন?’
গোর্কি মৃদু হেসে বলেন, ‘ঈশ্বর বললেন, আরেকবার চেষ্টা কর।বলাই বাহুল্য, গোর্কি দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
এখানেই গোর্কি দমে যাননি, আত্মহত্যার জন্য দ্বিতীয় প্রচেষ্টা ঘুমের বড়ি খেয়ে। এবারেও ব্যর্থ তিনি। ওই ব্যর্থতা ও বন্ধুর ভর্ৎসনা তাকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। মৃত্যুই যে মুক্তির একমাত্র পথ নয়, মুক্তির জন্য চাই সংগ্রাম- এ বোধ তার জাগ্রত হতে বেশি সময় লাগে না।
সৌভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন বলেই পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন মাক্সিম গোর্কি।
মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তাঁর শেষ কথা উচ্চারিত হয়েছিল ‘There’ll be wars.… We must be prepared!…’ Old Izergil-এর Donko চরিত্রটির মতোই তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
গোর্কি শেষজীবনে লেখা শুরু করেন তাঁর আরেক উপন্যাস ‘ক্লিম সামগিনের জীবন’। যদিও এই উপন্যাস তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
১৯৩৬ সালের ১৮ই জুন গোর্কি মারা যান। মৃত্যুর আগের বেশ কিছু সময় তাকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিলো। তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত রাশিয়া শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মস্কো রেডিও থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো, “মহান রাশিয়ান লেখক, শ্রমিকদের বন্ধু, সাম্যবাদের চিরযোদ্ধা ম্যাক্সিম গোর্কি মারা গেছেন।”
গোর্কির সাহিত্যকর্মের সংখ্যা খুব বেশী নয়। কিন্তু যতটুকু তিনি লিখে রেখে গেছেন তা চিরকাল অসহায়, নিপীড়িত মানুষকে জেগে ওঠার প্রেরণা জোগাবে, ছড়াবে সাম্যবাদের বাণী। কেননা গোর্কি শুধুই একজন সাহিত্যিক নন, বরং তিনি একজন মহৎ মানুষ এবং একজন বিপ্লবী।
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: