• ঢাকা
  • শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ; ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

ঢাকা  শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ;   ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

আমরা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে আছি। জানিই না আমাদের শেকড় কোথায়?

Nazmul Haque Bhuiyan
Daily J.B 24 ; প্রকাশিত: শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৮:০৬ এএম
ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আমাদের শেকড় কোথায়
ফাইল ছবি

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানে আমাদেরও প্রচন্ড পরিমান আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে। আমরা জানিই না আমাদের শেকড় কোথায়? ইংরেজ যাওয়ার আগে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেলো তোমাদের পূর্বপুরুষরা হচ্ছে দ্রাবিড়। তোমরা ছিলে অশিক্ষিত জংলী। তোমাদেরকে উন্নত জীবনের সন্ধান দিয়েছে আর্যরা। কারা আর্য? ইংরেজ বললো তারা বহু আগে সেই পশ্চিম থেকে ঘোড়ায় চড়ে লোহার তলোয়ার হাতে এসেছিল ভারতবর্ষে। অনেকটা আমাদেরই মত আরকি। তারা এসে তোমাদের সব কিছু ধবংস করে নতুনভাবে তোমাদের বাচতে শিখিয়েছিল।
আমরা শুধালাম, ওরা আমাদের সব কিছু ধ্বংস করেছিল?
ইংরেজ স্বান্তনা দিল, হ্যা, কিন্তু চিন্তা করে দেখো ওরা তোমাদের প্রস্তরযুগ থেকে উঠিয়ে ব্রোঞ্জযুগে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছিল। ওরা চাষের টেকনোলজি এনেছিল, ওরা ঘোড়াকে বশে রাখতে পারতো। ওরা তোমাদের চাকা বানিয়ে দেখিয়ে দিলো। তাইতেই না তোমরা উন্নত হলে কিছুটা।
আমরা সমস্বরে চিৎকার করে বললাম জয় হোক বিশুদ্ধ রক্ত আর্যদের। ওরা বাইরে থেকে এসে আমাদের আধুনিক করেছিল। ঠিক যেমন এখন ইংরেজরা এসে আমাদের আধুনিক করছে। জয় হোক।
আবহমান কাল ধরে আমাদের মাথায় গেথে দেয়া হলো আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিল জংলী। তাদেরকে উন্নত করেছে বহিরাগত আর্যরা। অদ্ভুতভাবে হিন্দু জাতিয়তাবাদী তাত্ত্বিকরা এই তত্ত্ব আরও প্রবলভাবে আকড়ে ধরলো। ঠিকই তো, আর্য যারা ফর্সা রং এর উন্নত জাতি, বিশুদ্ধ রক্তের বাহক তারা এসেই ভারতবর্ষের জংলী দ্রাবিড়দের মানুষ করেছিল। আর ব্রাম্মনরাই হচ্ছে তাদের প্রকৃত উত্তরসূরি। সুতরাং তারাই সবার চেয়ে উন্নত জাত৷
ইংরেজ শুধু আমাদের ইতিহাসই শেখায় নাই। তারা আমাদের ধর্মের আফিম গিলিয়েছে। ডিভাইড এন্ড রুল। ডিভাইড হয়ে আমরা মুসলমানরা ভাবতে বসলাম তাহলে আমরা কারা? আমরা নিশ্চয়ই সেই জংলী দ্রাবিড়ের বংশ হতে পারিনা যাদেরকে উন্নত করেছিল আর্যরা, যারা আজকের হিন্দু মালাওন! আমরা কারা?
ইংরেজ তখন স্বান্তনা দিলো, কান্দে না বাবু। তোমরা তো আরও বড় হনু।
কি রকম কি রকম?
আরে তোমরাই তো এতদিন শাসন করেছিলে ভারতবর্ষ। আর্যদের অত্যাচার থেকে দ্রাবিড়দের বাচিয়েছো তো তোমরাই। তোমাদের বীরেরা এই দেশে এসে রাজদন্ড হাতে নেয়ার ফলেই না সৃষ্টি হয়েছে আজকের ভারত। না হলে এই জংলী জাতি আর কতটুকুই বা উন্নতি করতে পারতো? দ্রাবিড়দের ভারতকে উন্নত করেছে আর্যরা, আর্যদের ভারতকে উন্নত করেছে মুসলমান আফগান, তুর্ক শেষে মুঘলরা আর মুঘলদের হাত থেকে ভারতের উন্নতি এসে বর্তিয়েছে বেনিয়া ইংরেজদের হাতে। ভারতকে হিন্দু মুসলমানে ভাগ করে ইংরেজ জাত তাদের আগ্রাসনকে জায়েজ করার ইতিহাস আমাদের গিলিয়ে দিয়ে গেল। আমরা গিলে না পারলাম হজম করতে না পারলাম উগরাতে।
কিন্তু সেই যে "আমি কি হনু রে" ভাব আমাদের মনে গেথে গেলো সেটা এখনও বিরাজমান। এই ভাবের ঠ্যালায় অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে আরব বাহিনী যখন সিন্ধু (অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধুপ্রদেশ) জয় করলো আমরা তার নাম দিলাম ইসলামের ভারত জয়। একবারও আমাদের মাথায় এলো না রাসুল (সাঃ) এর নাতি সাথে অগনিত সাহাবাদের হত্যা করে, মক্কার পবিত্র কাবা শরীফের দেয়ালে আগুন লাগিয়ে, মদিনায় লুন্ঠন হত্যাজজ্ঞ চালানোর পরও উম্মাদ ইয়াজিদের উমায়াদ খিলাফত "ইসলামী" থাকে কি করে?
অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের পর দশম শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে শুরু হয় টার্ক (তুর্ক) এবং আফগান ডাকাতদের ভারত আক্রমণ। এদের কেউ ছিল ডাকাত আবার কেউ ছিল আফগান বা তুর্ক রাজা বাদশাহ। কিন্তু উদ্দেশ্য তাদের অভিন্ন। ভারত বর্ষ থেকে সম্পদ লুট করা। কিন্তু ওদের আসল পরিচয় প্রকাশ করলে তো আর আমাদের "আমি কি হনুরে" ভাবটা বজায় থাকে না। তাই আমরা ওদেরকে বানালাম ইসলাম প্রচারক। ইসলাম প্রচারের জন্য সাথে ভারত বর্ষের মুসলমানদের অত্যাচারের হাত থেকে বাচাতেই ওরা নাকি ভারত বর্ষ আক্রমণ করেছিল। আলাউদ্দিন খিলজী, বখতিয়ার খিলজী, তৈমুর, ঘুরীরা হয়ে গেল আমাদের হিরো। ভারত আক্রমনের সময় ওরা যে কেবল হিন্দু মেরেছে তা কিন্তু না। মুসলমানও মেরেছে। সেদিকে "ইসলাম" প্রচারের উসিলায় আমরা চোখ বন্ধ করে রাখলাম। আমি এখনো বুঝতে পারি না ইসলামের নাম দিয়ে এসব ডাকাতদের হত্যাজজ্ঞকে ডিফেন্ড আমরা কেন করছি? ওরা কি কেউ আলেম ছিলেন?
যাই হোক ইতিহাসটা এরকম পাতিহাস হয়েই থাকতো যদি না মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা তথা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুজে না পেতেন। এর পর আরও পেয়ে গেলেন মেহেরগড়। পাতিহাসের ঝাক সরিয়ে সামনে আসতে শুরু করলো ইতিহাস। বর্তমানে আধুনিক জিনেটিক্স বা বংশগতি বিজ্ঞানের সাহায্যে হাজার বছরের পুরনো ফসিলের ডি এন এ পড়ে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন জেনিটিক্যালি আমরা ৬০/৭০ হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের সূচনা ৭০,০০০-৩৩০০ খ্রীষ্টপূর্বের। অর্থাৎ আজ পর্যন্ত পাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সভ্যতার সৃষ্টি আমাদের পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই, আমাদেরই এই উপমহাদেশ ভারতবর্ষে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সিন্ধু এবং মেহেরগড় সভ্যতা বিলুপ্ত হয় তথাকথিত আর্যরা আসার আগেই। তারমানে? তাহলে আর্যরা এসে যে জংলী দ্রাবিড়দের মানুষ করলো তারা কারা?
এখন প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে আর্য আর দ্রাবিড় বলে আলাদা কিছুই ছিল না। আর্যদের রূপ ধরে কেউ আসেই নি। পুরোটাই ইংরেজ ঐতিহাসিকদের ধাপ্পাবাজি। কাল্পনিক এই আর্যরা আসার অনেক আগেই আমরা যথেষ্ট সভ্য ছিলাম। 
কেমন ছিল সেই সভ্যতা? এক পোস্টে বলে শেষ করা যাবে না। স্রেফ সিন্ধু সভ্যতা লিখে গুগলে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন। বলা যায় প্রস্তর যুগ থেকে বিকাশ লাভ করে ব্রোঞ্জ যুগ পর্যন্ত আগত স্রেফ যদি হরোপ্পা নগরী ধরি সেই আমলে আজকের দিনের মত আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন এবং পানি সর্বরাহের সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ নগরী চিন্তা করা যায়? সাথে তিন তলা পর্যন্ত দালান! চাষের প্রকৃয়াও বাইরে থেকে আসে নাই, এই ভারতবর্ষেই সেটা আবিষ্কৃত হয় অন্যান্য স্থানের মত। পাওয়া যায় চাকার চিত্র। ঘোড়া পালার চিনহ। তাহলে সেই কাল্পনিক আর্যরা এনেছিল কি? ঘোড়ার ডিম?
সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি জনসংখ্যা ছিল এ সভ্যতার। স্বাভাবিকভাবেই জনবসতি বেশি হলে সেখানকার পরিবেশ অরাজকতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং ধারণা করা হয় বসবাসরত জনগণ ছিল বেশ শান্তিপ্রিয়।
শান্তিপ্রিয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত একটা সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের কিন্তু কোন ধারণাই নাই। আমরা জানিই না বা জানলেও মানতে চাই না এরাই আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল৷ জগৎ বিখ্যাত মহাবীর আলেক্সান্ডারের প্রবল প্রতাপশালী সেনাবাহিনীকে থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল গঙ্গারিঢ়ির কোন প্রতাপশালী রাজা! আমাদেরই তো গর্বিত পূর্বপুরুষ। আমরা দেখলাম কেবল সেই রাজার ধর্মটা। ব্যাটা তো হিন্দু, মালাওন।
আর আমাদের ইসলাম? ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম আসার জন্য কারও তলোয়ারের উপর ভরসা করতে হয় নাই। 
৬২৯ সালে অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ(স) (৫৭১–৬৩২ খ্রি.) জীবিত থাকা অবস্থায়ই ভারতবর্ষে স্থাপিত হয় প্রথম মসজিদ। জুম্মা মসজিদ নামে এটি এখনও সগর্বে দাড়য়ে আছে। কে বানিয়েছিলেন এই মসজিদ? 
দক্ষিণ ভারতের চেরা রাজবংশের শাসক রাজা চেরামান পেরুমল। তিনি তার রাজ্য ত্যাগ করে ভারত থেকে মক্কায় উপস্থিত হন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) এবং আরও অনেক প্রখ্যাত সাহাবার উপস্থিতিতে হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নবী তার নাম রাখেন তাজউদ্দিন। সতোরো দিন তিনি নবী মুহাম্মদের সাথে থাকেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় তিনি একজন সাহাবা। তিনি সাহাবী মালিক বিন দীনার-এর বোন রাজিয়াকে বিবাহ করেন। এরপর মালিক বিন দিনারকে সাথে নিয়ে মাতৃভূমিতে ফেরার পথে ওমানে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন। মৃত্যুর পূর্বে তার দেয়া শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সাহাবী মালিক দীনার ভারতে এসে চেরমন রাজার জন্মভূমি কেরালার মেথেলায় ভারতের প্রথম জামে মসজিদ, চেরামন জুম্মা মসজিদ নির্মাণ করেন, যা বহু কাল ধরে এখনো ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে। কেউ তো বাধাও দেয় নাই ভাঙেও নাই।
আমরা কি এই মসজিদের কথা জানি? কেন জানি না। এটা জানানো হলে তো বিন কাশিম, তৈমুর, খিলজির তলোয়ারের আর ইসলামী মূল্য থাকে না। আমরা নিজেদেরকে তাদের বংশধর বলে ভাবতেই তো গর্ববোধ করি। "আমার পূর্ব পুরুষ সুদূর ইয়েমেন, তুরস্ক, আরব থেকে এসেছিল"-- বলে আমরা অযৌক্তিক গর্বে গর্ভবতী হয়ে বসে থাকি। সেই সুদূর আরবটাকেই আমরা গায়ের জোরে আপন বানাতে চাই। আমার পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিল, এই চিন্তা যাতে আমাদের মাথায় না আসে তার জন্য আমাদের শেখানো হয় আর্যরা আসার আগে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না, তেমনি ইসলাম আসার আগে ভারতবর্ষেও ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে। কেন এই মিথ্যা শিক্ষাটা দেয়া হচ্ছে? এক সতি দাহ প্রথার উসিলায় একটা পুরো উন্নত সভ্যতার মুখে আমরা কালি লেপে দিচ্ছি কোন যুক্তিতে? অথচ অন্যদিকে ইসলামের নামে মুঘলদের হেরেমবাজী, সিংহাসনের জন্য নিজের ভাইকে দূর্গের ছাড থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা, নিজ পিতাকে জীবিত বন্দী করা এগুলোকে জায়েজ করে দিচ্ছি! এরা "ইসলামী" শাসক? একটা মুঘল বাদশাহও তো হজ্জ করতে মক্কায় গেলেন না। এরা শাসনের সুবিধার্থে স্রেফ ধর্মটাকে ব্যাবহার করেছিলেন, এছাড়া আর কিছুই না।
আমার পূর্ব পুরুষ হিন্দু ছিলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত এক সভ্যতার ধারক ছিলেন, যুদ্ধবিদ্যায়, বীরত্বে তারা মহান ছিলেন এই সত্য স্বীকার করে নিলে কি আমার ইমান চলে যাবে? হযরত উমর (রাঃ)সহ সকল সাহাবাই তো কাফের থেকেই তো কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলেন। তারা কি তাদের আগের পরিচয় মুছে ফেলেছিলেন? নামও তো পরিবর্তন করেন নি কেউ। যার যার গোত্র প্রথাও ভাঙেননি। কিন্তু আমরা কি হনু রে……..চিন্তা করতে করতে আমরা হইলাম না ঘরকা না ঘাটকা।

 

Nazmul Haque Bhuiyan

Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক

বিবিধ সংবাদ বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ