• ঢাকা
  • শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ; ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

ঢাকা  শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ;   ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

আমাদের রাজনীতি বিমুখতার প্রভাব

সায়েদুল আরেফিন , কলামিস্ট ও উন্নয়ন কর্মী
Daily J.B 24 ; প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ১২:৪৪ এএম
রাজনীতি,রাজনীতি বিমুখতা ,  বাংলাদেশ , অজ্ঞতা
ফাইল ছবি

 

ইদানীং আমাদের দেশের যুব সমাজের মধ্যে একটা নতুন ফ্যাশন হয়েছে যে অধিকাংশই প্রায় বলে থাকেন “এই হেট পলিটিক্স”। লেখা পড়ার ক্ষেত্রে মেধাবীরা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, আমলা, আর্মি, পুলিশ, ইত্যাদি হবার লক্ষ্যেই পড়াশুনা করানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে বাসা-বাড়ি, বন্ধুদের আড্ডা, চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, অফিস, আদালত সবখানেই রাজনীতির আলাপ চলে বিরামহীন। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়েও চায়ের দোকানে নানামুখী তুমুল আলোচনা দেখা যায়। আপনি ক্রিকেট না বুঝলে হয়তো ধরে নিতে পারেন যারা আলোচনা করছেন, তাঁরা কেউ কেউ বড় কোন নামকরা দলের ভালো কোন ক্রিকেট প্লেয়ার ছিলেন, বর্তমান পেশা যাই হউক না কেন।      

যা হউক, যেটা নিয়ে শুরু করেছিলাম সেটাতেই ফিরে আসি। দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে "মানুষ প্রকৃতিগত-ভাবেই রাজনীতি প্রিয় প্রাণী" আর তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় রাজনীতি। বাস্তবে এই রাজনীতি বিষয়ক আলোচনাগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হয় চরম নেতিবাচক আলোচনা। আলোচনা শুরুই হয় রাজনীতি কতটা খারাপ সেই বিশ্লেষণ করে এবং শেষ হয় রাজনীতি থেকে আমাদের কতটা দূরে থাকা উচিৎ তা দিয়ে। সেখানে একই ব্যক্তির মাঝে দেখা যাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, পাড় অর্থনীতিবিদ, আইটি বিশেষজ্ঞ, কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক, ইত্যাদি তাবৎ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ-পর্যায়ের জ্ঞান, যদিও বাস্তব জীবনে তাঁরা সে সব বিষয়ে কোন লেখাপড়াই করেননি বা, চর্চাও করেননি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ইনারা বাস্তব জীবনে সবাই রাজনীতি বিমুখ মানুষ।      


 
দেশ প্রেমিক বা অভিজ্ঞরা বলেন যে, “পেশাগত জীবনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি, পুলিশ, দোকানদার, ঠিকাদার, পাহারাদার, অফিসার, কেরানী, পিয়ন, চাপরাশি, বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, শিল্পী বা খেলোয়াড় যা কিছুই হোন না কেন, আপনার দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আপনার অবশ্যই দেশের রাজনীতির দিকে একটি চোখ থাকতেই হবে। আপনি ভাবছেন, আপনি তো রাজনীতি করছেন না, তাহলে আপনি কেন এসব নিয়ে ভাববেন? আপনি ডাক্তার, আপনি আপনার চিকিৎসা নিয়ে থাকবেন, রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? আপনার এই মানসিকতা সমাজ এবং রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশের অন্তরায়।“ 


 
অভিজ্ঞরা মনে করেন যে, মেধাবী ও শিক্ষিত মানুষেরা রাজনীতিতে না আসার ফলে আমরা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছি। কারণ একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতি ছাড়া দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি অসম্ভব। সেখানে দরকার শিক্ষিত, লেখাপড়া জানা মেধাবী মুখ, বুদ্ধিমান মানুষের মেলা। তা না হলে জমি অধিগ্রহনের সময় একটি কলা গাছের ক্ষতিপূরণ ধরা হবে ১০ হাজার টাকা কিংবা একটি নারকেল গাছের জন্য ১ লাখ টাকা। হাসপাতালের দুই পাটের ১ সেট জানালার পর্দা ২৭ লাখ টাকা কিংবা ১ টা বালিশ কেনা হবে ৭ হাজার টাকায়। এর জন্য পরোক্ষভাবে আপনিও দায়ী, কারণ আপনার মত জ্ঞানীরা পলিটিক্সকে “হেট” করেন। স্বল্প শিক্ষিত রাজনীতিকরা প্রকল্পে “বিদেশী জড়িত বিধায় ইংরেজি” লেখা ফাইলের নোটের অর্থ না বুঝেই তাতে সম্মতি দেন। তাই সব দোষ এসে পড়ে রাজনীতিবিদদের ঘাড়ে, যদিও প্রকল্পের কেনা কাটার আসল রস উপভোগ করেন “জ্ঞানী আমলারা”।      


                                                                                                     
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাদে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে যারা রাজনীতি করেন তাদের অধিকাংশই প্রায় স্বল্প শিক্ষিত। যারা নিজেদেরকে শিক্ষিত হিসেবে দাবী করেন, তারা প্রায় সবাই বলতে গেলে স্কুল কলেজের ব্যাক-বেঞ্চার। এদের থেকে একটু যারা ভালো তাঁরা হন আমলা বা ক্যাডার অফিসার বা কর্পোরেট হাউজের কর্তা। তার চেয়ে যারা একটু ভালো তার হন কৃষিবিদ, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। কিছু মেধাবী উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই হন সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার। 

 

যেহেতু প্রশাসনিক ক্যাডারের আমলারা রাজনীতিবিদ্গণের সাথে সরাসরি পলিসি ইস্যু আইন প্রণয়নে কাজ করেন তাই মনে হয় বাংলাদেশের আইনে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের সচিবকে। তিনি তার মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সকল দপ্তরের এডমিনিস্ট্রেটিভ চীফ ও একাউন্টিং চীফ। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া রাজনীতিবিদদের কোন ক্ষমতা নেই। কিন্তু সমস্ত দায়ভার চাপে রাজনীতিবিদের ঘাড়ে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, রাজনীতিবিদগণ স্বল্প শিক্ষিত হবার কারণে নির্ধারিত এমপিদের সাহায্য করতে(!) আমলা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ্গনের মধ্যস্ততায় এগিয়ে এসে সংসদে উপস্থাপিত প্রায় সব আইনের খসড়া করেছেন আমলারা; তাঁদের ভাষা না বুঝেই রাজনীতিবিদগণ আইনের খসড়ার অনুমোদন দেন, কারণ তাঁরা ভাষার প্যাচ বোঝেন না। সেই সুযোগ নেন তাঁদের চেয়ে মেধাবী বিভিন্ন ক্যাডারের আমলারা, যাদের পক্ষে দালালী করেন আমলা রাজনীতিবিদ এমপি ও অসৎ ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ এমপি। এতে আইনের ফাক রেখে আইন প্রনীত হয়। সেই ফাক গলে নষ্ট ব্যাবসায়ী রাজনীতিবিদগণ রাতারাতি কোটিপতি হন, তাতে ভাগ থাকে আমলা ও আমলা রাজনীতিবিদ ও কিছু নষ্ট রাজনীতিকের।       

 

আমরা যতোই ‘আই হেট পলিটিক্স’ বলি না কেন, শেষ পর্যন্ত এই পলিটিক্সের কাছে আমরা অসহায়। সুতরাং, দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে রাজনীতিকে এড়িয়ে চলার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সবাইকে রাজনীতি করতে হবে তা নয়, তবে রাজনীতি সচেতন হতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে সবচেয়ে মেধাবীরা রাজনীতি করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি বহুলাংশেই অসৎ, মেধাহীন, অযোগ্য এবং অপদার্থদের দখলে। দেশটা আমাদের সকলের। তাই আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে হলে যোগ্য এবং সৎ লোকদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসতেই হবে। তা না হলে বিশেষ সুবিধা নিতে অবসরে যাওয়া আমলা ও ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসে নাজায়েজ ফায়দা নেবে, বর্তমানে যা হচ্ছে। নষ্ট কিছু শিক্ষিত মানুষ নানাভাবে নিজের ও গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিলের জন্য দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করবে মিডিওয়ায়, তাঁদের মুখে লাগাম দেওয়ার মত কেউ থাকবে না রাজনীতিবিদদের মাঝে। মিডিয়ার এই মিথ্যাচারে কাউণ্টার দেবার ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেই বললেই চলে।   

 

খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন শিশু ছোটবেলা থেকে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা শুনতে শুনতে বড় হয় এবং তরুণ বয়সে এসে উপলব্ধি করে রাজনীতি থেকে তার কতটা দূরে থাকা উচিৎ। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা সেই তরুণের মধ্যে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক সচেতনতা-বোধ তৈরি হয় না। রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করাকে সে একধরনের অপরাধ বলে ভাবতে শেখে। রাজনৈতিক সচেতনতা বলতে আমরা বুঝি রাজনীতি সম্পর্কে মৌলিক পড়াশোনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অধ্যয়ন এবং সমসাময়িক ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিজের ও নিজের সার্কেলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক মতামত সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক সচেতনতা মানে কোন দলের লেজুড়বৃত্তি নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের বাংলাদেশে কোন দলের চামচা বা দালাল বলা হয়। 

 

বাস্তব কথা হচ্ছে সৎ, মেধাবীরা যদি রাজনীতিতে না আসেন বা রাজনৈতিক সচেতন না হন তাহলে রাজনীতিবিদ্গনের কাজের সমালচনা করার নৈতিক অধিকার তাঁদের থাকে না। রাজনীতিবিদগণ বলতে না পারলেও আমাদের মত কিছু “আহাম্মক আছেন যারা বলবেন, আপনি আচরি ধর্ম, অপরে শেখাও”।   

এমপি সাহেবগন আইন প্রণয়ন করবেন, মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় চালাবেন, আর রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিগত দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করবেন। সরকারের হাতে এমন হাজার হাজার পদ আছে যেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান আছে। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের চেয়ে নানা পেশার রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিগন অনেক বেশি উপযোগী। কিন্তু রাজনীতির প্রতি অনীহার কারণে কোন সরকারই আমাদের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারে না।   
  


রাজনৈতিক অসচেতনতার কুফল বর্ণনা করতে গিয়ে প্লেটো বলেন "রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার জন্য একটি দণ্ড হচ্ছে যে আপনি আপনার চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা শাসিত হবেন"। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোনোভাবে করা যায়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সামিল। 
 
জার্মান নাট্যকার ও কবি বেটোল্ড ব্রেখট এর মতে, “নিকৃষ্টতম মূর্খ হল সে, যে রাজনৈতিকভাবে মূর্খ। সে শুনতে চায় না, বলতে চায় না, রাজনৈতিক বিষয়ে অংশগ্রহণ করে না। সে জানে না জীবনের মূল্য, ধান-মাছ-আটা-বাসা ভাড়া-জুতা বা ঔষুধের  দাম- সব কিছু নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর। এই রাজনৈতিক অজ্ঞ এতোই মূর্খ যে, বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলে, আমি রাজনীতিকে ঘৃণা করি। এই নির্বোধ জানে না, তার রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান এবং সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ভণ্ড রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ এবং দেশী-বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানির ভৃত্য দালাল।“ 

 

 

© সায়েদুল আরেফিন
কলামিস্ট ও উন্নয়ন কর্মী

 

Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক

সম্পাদকীয় বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ