• ঢাকা
  • সোমবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ; ০৫ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

ঢাকা  সোমবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ;   ০৫ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

একটি হিন্দুত্ববাদী পাঠ্যপুস্তকীয় চুলকানীর ইতিবৃত্তঃ

নাজমুল হক রাজিব 
Daily J.B 24 ; প্রকাশিত: সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১০:০৭ পিএম
হিন্দুত্ববাদী, পাঠ্যপুস্তকীয় চুলকানী, শিক্ষা , পিনাকী ভট্টাচার্য

=>চুলকানীর স্থানঃ ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান-অনুশীলন বইয়ের পৃষ্ঠা নাম্বার ৯৮/৯৯।

 


=>চুলকানীর বিবরনঃ পাঠ্যবইতে মুসলিম শাসকদের হেয় করা হয়েছে। বলা হয়েছে মুসলমান শাসকরা বাইরে থেকে এসে বাংলা আক্রমণ করেছিল। অন্যদিকে হিন্দু শাসকদেরকে স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে দেখানো হয়েছে। মহান ছা-গগুরু পিনাকীর ভাষায়, "পাঠ্যবইতে বলা হচ্ছে খিলজী আক্রমণকারী কিন্তু সেনরা আক্রমণকারী নয়। সেনদের তথা হিন্দুদের ভালো দেখানোর জন্য মুসলিমদের আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে।"
=>চুলকানীতে আক্রান্ত প্রধান রোগীঃ পিনাকী ভটভটি, তার কাছ থেকে আহামদুল্লাহ হুজুর এবং Go on…..


=>চুলকানীর মলমঃ 
এখানে তথ্য লুকানো হয়েছে। পিনাকী জা-রোজটা স্পষ্টত চেরি পিকিং করেছে। বাস্তবে বইতে সেন এবং হিন্দু রাজাদেরকেও আক্রমণকারী হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, "পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চাভিলাষী অভিজাত যোদ্ধাদের অনেকেই বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন, ভূখণ্ড ও সম্পদ দখল করেছেন এবং সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য না দিয়ে তাদের ভাষাধর্ম-রাজনীতি এখানকার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যেমন মৌর্য রাজা, গুপ্ত রাজা, সেন রাজা, খলজী রাজা, হোসেন শাহ সুলতান, নবাব মুর্শিদ কুলী খান, বৃটিশ এবং পা-কি-স্তানি শাসক।"
অর্থাৎ স্পষ্ট বলা হচ্ছে, মৌর্য রাজা, গুপ্ত, সেন রাজা যারা হিন্দু ও খিলজী, হোসেন শাহ, সুলতান, নবাব মুর্শিদ কুলী খান এবং পা-কি-স্তানিরা মুসলিম শাসক এবং মাঝের ইংরেজরা এরা সবাই বাইরে থেকে আসা আক্রমণকারী। অথচ পিনাকী স্রেফ খিলজীর বাংলা আক্রমনের পৃষ্ঠাটা দেখিয়েই তাল তুলেছে কেবল মুসলমানদেরই আক্রমণকারী বলা হয়েছে, হিন্দুদেরকে না। এটাই নাকি মোদীর মতবাদ। আচ্ছা আসেন দেখি এটা কার মতবাদ।
পিনাকি তার ভিডিওতে দেখিয়েছে ৯৯ নং পৃষ্ঠা এবং সে তাতে হাইলাইট করেছে এই প্যারাটা,(ছবি)

 


"শুরু থেকেই তোমরা দেখেছো, বাংলা অঞ্চলের মানুষের উপর ভূ-মধ্যসাগরের আশে-পাশের অঞ্চল, পারস্য (ইরান) এবং অন্যান্য অঞ্চলের তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী দখলদারিত্ব এবং আধিপত্য বিস্তার করেছে। বাংলা অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য প্রায় সব সময়ই বহু দূরের ভূ-খণ্ড হতে আগত সুবিধাবাদী তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী নির্ধারণ করেছে।"
এরপরের দুইটা লাইন সে হাইলাইট করে নাই। সেই দুইটা লাইন হচ্ছে,

 


"এই ভূ-খণ্ডের অনার্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষেরা বারবার শোষিত হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা অবস্থান করেছে তারা কেবল নিজেদের নাম-যশ-খ্যাতি ও সুবিধা লাভের চিন্তায় থেকেছে বিভোর।"


কেন সে ওই দুই লাইন বাদ দিয়েছে? লাইনটা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। "এই ভূ-খণ্ডের অনার্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষেরা বারবার শোষিত হয়েছে"। কারা এই অনার্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ? তারা হচ্ছেন আমাদের ভূখন্ডের একেবারে প্রাচীন অধিবাসী অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, চৈনিক ও তিব্বতী-বর্মী ভাষার মানুষেরা। ৩২৭ সাধারণ পূর্বাব্দে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রিক যোদ্ধা আলেকজান্ডার আক্রমণ করেছিলেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে কিছু অংশ জয় করে হঠাৎই আলেকজান্ডার থামতে বাধ্য হয়েছিলেন। গ্রিক ও লাতিন ঐতিহাসিকদের মতে, আলেকজান্ডারকে তার ভারতবর্ষ জয়ের অভিযান থামাতে হয়েছিল শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যের ভয়ে। কি নাম সেই শক্তশালী সাম্রাজ্যের?


গ্রিক ও লাতিন ঐতিহাসিকদের মতে, আলেকজান্ডার তার ভারতবর্ষ অভিযান থেকে সরে এসেছিলেন কারণ তাহলে তাকে প্রবল শক্তিশালী গঙ্গাঋদ্ধি সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে হতো। আলেকজান্ডার আশঙ্কা করছিলেন বিশাল সামরিক শক্তি সম্পন্ন গঙ্গাঋদ্ধি সাম্রাজ্য আক্রমণ করার পরিণতি তার জন্য হবে ভয়াবহ। কিন্তু কারা সেই সাম্রাজ্যের অধিবাসী যাদের সামরিক শক্তি দেখে জগৎজয়ী আলেকজান্ডার পর্যন্ত থমকে গেছেন? তারা কারা?


উত্তর দিচ্ছেন টলেমি, "আজ থেকে ঠিক দু’হাজার তিনশাে বছর আগের কথা। বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরে পঞ্চ আব অর্থাৎ পঞ্চনদীর দেশ পাঞ্জাবের বিপাশা নদীর ধারে এসে  গঙ্গা নদীর মােহনায় সমুদয় এলাকা জুড়িয়া গঙ্গারিডিদের রাজ্য।"

 


উত্তর দিচ্ছেন প্লিনি, "গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের ভিতর দিয়া গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হইয়াছে।"
চিনতে পারছেন না?


তবে শুনুন গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে কি বলছেন, "ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ অঞ্চল জুড়ে গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য বিস্তৃত ছিল।"
এবার চিন্তা করেন কোনটা ছিল বঙ্গ অঞ্চল?
টিউবলাইট জলছে?


বঙ্গ অঞ্চল ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
অর্থাৎ সেই প্রবল পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা আমাদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন। [যদিও তখন আমাদের সাথে জুড়ে ছিল বর্তমান ভারত, নেপালের কিছু অংশ।]
[এ ব্যাপারে আমার একটা পুরনো পোস্ট আছে এইখানে https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=5324093740942375&id=100000254067262&mibextid=Nif5oz]
এরপর দেখেন কি বলছে আমাদের আলোচ্য বর্তমান পাঠ্যবই ৯৫ পৃষ্ঠায়,

 


"আলেকজান্ডারের চলে যাওয়ার কিছুকাল পরেই উত্তর ভারতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নামে একজন সম্রাটের উত্থান হয়। তিনি মৌর্য নামে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। ধীরে ধীরে তারা ভারতের আদি অধিবাসীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে করতে পূর্ব দিকে বাংলা অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।"


অবশেষে তারা দখলে নেয় বঙ্গ। কিন্তু কারা ছিল এই মৌর্য?


বলছে বর্তমান পাঠ্যবই, "মৌর্যরা ছিল আর্য ভাষাভাষী অভিজাত মানুষ। আনুমানিক ৩৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দে তারা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল।" (পাঠ্যবই ৯৫ পৃষ্ঠা)
অর্থাৎ আমাদের বর্তমান পাঠ্যবই বলছে মৌর্য সাম্রাজ্যের আর্য ভাষাভাষী সেই অভিজাত মানুষরাই ছিল আমাদের দেশ প্রথম আক্রমণকারী, মুসলিমরা নন।
মনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কারা ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের আর্য ভাষাভাষী সেই অভিজাত মানুষরা। এই প্রশ্নেরও উত্তর দিচ্ছে বর্তমান পাঠ্যবই, 


"মৌর্যদের আলোচনা প্রসংগে আর্য ভাষা এবং এই ভাষায় লেখা কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে তোমাদের জানা প্রয়োজন। আর্য ভাষাভাষী মানুষের হাতে রচিত হয়েছিল রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, পুরাণ নামক সংস্কৃত গ্রন্থ।" (পাঠ্যবই ৯৫পৃঃ)
কি? পিট পিট করছে টিউবলাইট?


রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, পুরাণ নামক সংস্কৃত গ্রন্থগুলোকে বর্তমানে কারা নিজেদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্রগ্রন্থ হিসেবে পরিচয় দেয়?
উত্তরঃ বর্তমান হিন্দুধর্মালম্বীরা।


ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রগ্রন্থে কতগুলো উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে আর্য শব্দে নির্দেশ করা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থ্রে হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকমাত্রেই অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র - এ চার বর্ণের লোকই আর্য বলে লিপিবদ্ধ আছে। আবার, কোনো কোনো গ্রন্থে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য - এ তিন বর্ণকে আর্য এবং চতুর্থ বর্ণকে শূদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। 


[তথ্যসূত্রঃ 
১) Encyclopaedia of Teaching of Agriculture- Page:411, Written by Arun Kumar
২) Encyclopaedia of world religions- Page: 186,
Merriam-Webster.
৩) Encyclopedia of Anthropology- Page:1026
Book by Tim Ingold.]

 


এখানেই মজা। এবার আসেন পিনাকীর চুলকানিতে। পিনাকি বলছে এই ইতিহাস নাকি মোদীর ভাষা। অর্থাৎ আরএসএস/বিজেপি'র মত কট্টর হিন্দু মৌলবাদিদের ইতিহাস নাকি আমরা আমাদের প্রজন্মকে শেখাচ্ছি। কিন্তু খেয়াল করেন, পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস অনুযায়ী আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী। এখন আপনি যদি বর্তমানে ভারতের আরএসএস/বিজেপির কোনো কট্টর ভক্তকে বলেন, "আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী" তাহলে তারা আপনাকে মারতে উঠবে। বর্তমানে তারা অর্থাৎ কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে ইতিহাসে এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত করতে যে আর্যরা বাইরের থেকে আসেনি, বরং তারাই ভারতের আদী বাসিন্দা।
এর প্রমাণ হিসেবে নিতে পারেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপির হিন্দুত্বের পোস্টারবয় যোগী আদিত্যনাথের গোরক্ষপুরের এক অনুষ্ঠানে করা দাবিকে। তিনি দাবি করেছিলেন, "আর্যরা বাইরের কোনও দেশ থেকে আসেনি। আর্যরা ভারতে কোনওদিন আক্রমণ চালাননি। আর্যদের মূল ভারতেই। বেদ, পুরান, উপনিষদ বা রামায়ণ এবং মহাভারত সহ হিন্দু ধর্গ্রন্থের কোনটিই বলে না যে আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে। এমনকি মা সীতা রামায়ণে ভগবান রামকে আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু ধূর্ত ব্রিটিশরা বামপন্থী মতাদর্শের ইতিহাসিকদের লিখতে বলে যে আর্যরা বাইরে থেকে এসেছিল।"


[তথ্যসূত্রঃ  https://bangla.hindustantimes.com/.../yogi-adityanath...]


অর্থাৎ পিনাকীর কথা অনুযায়ী আমাদের পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস যদি মোদীর ভাষা অনুযায়ী হতো তাহলে আর্যদেরকে বহিরাগত আক্রমণকারী হিসেবে দেখাতো না। পিনাকী খুব ভালোভাবেই জানে যে বিজেপি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাড়াবার জন্য মুসলিম শাসকদেরকে বহিরাগত বলে প্রতিনিয়ত গালাগালি করে। তাই সে বইতে কি ছাপানো আছে সেটা পুরো না দেখিয়ে সেই নির্দিষ্ট অংশগুলো হাইলাইট করে গল্প ফেদেছে যে বিজেপি'র মত আমাদের বইয়েও মুসলিম শাসকদেরকে বহিরাগত বলে গালাগালি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে সব মুসলিম শাসকরা বহিরাগত আক্রমনকারী এবং আর্যরা স্থানীয়। অথচ ঘটনা পুরাই উল্টা। আমাদের বইতে মুসলিম শাসক এবং আর্য উভয়কেই বহিরাগত বলা হয়েছে। আর্য ভাষাভাষীরাই হিন্দু ধর্মের মূল প্রবক্তা। 


যেমন পাঠ্যবইয়ের ৯৬ পৃষ্ঠায় আছে,
"ভারতবর্ষে আর্যরাই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই ধর্মের রয়েছে নিজস্ব গ্রন্থ, নিজস্ব সংস্কৃতি। সেকালে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষেরা নিজ সমাজের বাইরের সবাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করতো। তারা নতুন অঞ্চল দখল করে সেখানে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে থাকে প্রবলভাবে। আর্য ভাষাভাষী মানুষের হাতে রচিত মহাভারতে বাংলার প্রাচীন দুইটি জনপদ 'বঙ্গ' এবং 'পুণ্ড্র'-এর নাম পাওয়া যায়। আর্য ভাষাভাষীদের রচিত অন্য কয়েকটি গ্রন্থে বঙ্গ এবং পুণ্ড্রের মানুষদেরকে 'দস্যু', 'অসভ্য', 'নিচু' শ্রেণীর বলে অভিহিত করা হয়েছে। আসলেই কি কোনো অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে এইভাবে হেয় করা যায়? সকলেই তো আমরা মানুষ। মানুষ পরিচয় সবার আগে। আভিজাত্য, ক্ষমতা এবং ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির বড়াই করে কাউকে হেয় বা অসম্মান করা একেবারেই অনুচিত। আর্য ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো সব সময়ই নিজেদের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিকে 'শ্রেষ্ঠ' এবং অনার্য ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিকে 'ছোট' দৃষ্টিতে দেখেছে৷ অথচ এই অনার্য ভাষা গোষ্ঠীর মানুষেরাই বাংলা অঞ্চলে সুসংগঠিত সমাজ ও সভ্যতা রচনা করেছিল। যার প্রমাণ পাণ্ডু রাজার ঢিবি, যা কিছু আগেই তোমরা জেনেছো। কিন্তু তোমরা দেখবে, বাংলার দূরবর্তী ভূ-খণ্ড থেকে যখনই নতুন কোনো ভাষা, রাজশক্তি এবং ধর্ম ভারতের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করেছে, তখনই সেখানকার মানুষদেরকে অনার্য বলে হেয় করেছে, অসম্মান করে তাদের গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ করেছে। অভিজাত শ্রেণীর আর্য ভাষাভাষী কতিপয় মানুষের এই বড়াই ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য নয়।"


এ তো উলটা হিন্দুত্ববাদের পিন্ডি চটকাচ্ছে। পিনাকী এই পৃষ্ঠা মরে গেলেও দেখাবে না।


মৌর্যদের পর আসে গুপ্ত বংশের শাসন। এরপর পাল রাজবংশ এবং পালদের পর একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন রাজারা বাংলা অঞ্চল দখল করে নেয়। সেনদের কাছ থেকেই বাংলা আক্রমণ করে দখলে নেয় বখতিয়ার খিলজী যার পর থেকে সময়কে মুসলিম শাসনকাল হিসেবে গন্য করে অর্গাজমের স্বাদ পায় আমাদের বর্তমান মোল্লা পাট্টি। তাদের ইতিহাস শুরু হয় এখান থেকে, অর্থাৎ মুসলমান খিলজীর শাসন থেকে। ধর্ম অনুসারে চিন্তা করলে এর আগে বাংলা অঞ্চলের মানুষ যে ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শৈব ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম এবং জনপ্রিয় লোকধর্ম-এর অনুসারী ছিল তা তারা অস্বীকার করতে চায়। অথচ ইসলাম কিন্তু খিলজীর কারনে প্রসারিত হয় নাই। খিলজী স্রেফ একজন রাজ্যলোভী যোদ্ধা ছিল, আলেম ছিল না। সকল পুরনো ধর্মের কাল পেরিয়ে ধীরে ধীরে পীর, সুফি, দরবেশ ও পরবর্তি সুলতানদের প্রচারনায় ইসলাম বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুতই পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। একটা ব্যাপার আমরা আমলেই নেই না যে, ইসলাম স্পেনে গিয়েছিল তলোয়ারের জোরে৷ এবং সেই কারণেই স্পেনে ইসলাম টিকে নাই। কিন্তু ভারতবর্ষ তথা আমাদের দেশে ইসলাম এসেছিল সুফি দর্শনের উদারতা নিয়ে৷ তাই নতুন এবং উদার ধর্ম হিসেবে তা স্থানীয়দের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় এবং আজ পর্যন্ত টিকে যায়।


কিন্তু এইভাবে বার বার বাইরের আক্রমণ সহ্য করে আক্রমণকারীদের সাথেই কিভাবে মানিয়ে চলা শুরু করেছিলেন স্থানীয় দ্রাবিড়রা? 
পাঠ্যবইতে ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, "হাজার বছর পূর্বে এই ভূমিতে প্রথম বসতি স্থাপনের সময় যে রীতি-নীতি প্রথা ও সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়েছিল সাধারণ মানুষ তা কখনোই সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করেনি। এই কারণেই দেখা যায় বাংলায় নানা ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও এই ভূমির সকল মানুষ সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এক আশ্চর্য বন্ধনে আবদ্ধ। ধর্মের চেয়ে মানুষ পরিচয় সব সময়ই এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। চণ্ডিদাস থেকে শুরু করে লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম- সবাই মানবতার জয়গান করেছেন। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি চণ্ডিদাস লিখেছেন,
'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।"


এখানে চন্ডিদাসের নাম পড়ে পিনাকী গর্দভটা ভিডিওতে আরও কিছুক্ষন শু-য়ারের মত ঘোৎ ঘোৎ করলো। আমি সেই বক্তব্য খন্ডনে যাবো না কারণ চন্ডীদাস বা তার বানীর গুষ্টি উদ্ধার করাটা এখানে মূখ্য আলোচ্য বিষয় না। একমাত্র ছা????ল ছাড়া কম বেশি সবাই জানে যে চন্ডিদাস একজনের নাম না। তিন ব্যাক্তির নামের সমষ্টি। কোন কাব্যটা কোন চন্ডিদাস রচনা করেছেন তা এখন আর আলাদা করে জানা সম্ভব না বলে তিনজনকেই একত্রে চন্ডিদাস হিসেবেই উল্লেখ করা হয়৷ এইটা নিয়ে পিনাকী এমন ভাব ধরলো যেন তলে তলে কি না কি সে বের করে ফেলেছে। তবে হ্যা এই পদটির "মানুষ" বলতে সহজিয়া বৈষ্ণবেরা এইখানে গুরুকে বোঝান। যেহেতু তারা কোনো দেবদেবী মানেন না তাই শুরুর বাক্যই তাঁদের কাছে বেদ। [তথ্যসূত্রঃ পদাবলী-মাধুৰ্য্য, পৃঃ ১৫৬, দীনেশ চন্দ্র সেন] কিন্তু আক্ষরিক অর্থে গুরুও তো সেই সাধারণ মানুষই। তাই পিনাকী যে দিকে ইশারা করছে সেটাও গ্রহণযোগ্য না। তাছাড়া পদাবলীর মধ্যে অনেক উচ্চাঙ্গের সাধনা আছে বিধায় তা সাধারনের বলার বা শোনার অধিকার নাই। পিনাকী হুদাই ব্যাপারটা নিয়ে অহেতুক ত্যানা পেচাইলো।
পাঠ্যবইয়েরই ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠার আরেকটা প্যারা কোট করে শেষ করছি,


"বাংলা অঞ্চলে যেসব রাজার নাম তোমরা পাবে তাদের অধিকাংশই দেখবে বাংলা ভূ-খণ্ডের সীমানার বাইরে বহুদূর থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন। তার মানে কি জানো? তার মানে হচ্ছে, বাংলায় আদি যে অধিবাসীরা ছিলেন রাজক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না। তারা ছিলেন সাধারণ। প্রতিকূল প্রকৃতি আর হিংস্র জীব-জন্তু হতে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে জীবন ধারণ করাই ছিল তাদের জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলা অঞ্চলে তাই যখনই কোনো রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বহু দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসা এলিট/ অভিজাত প্রশাসক [যেমন ধরেন আর্য] অথবা উচ্চাভিলাষী কোনো যোদ্ধা [যেমন ধরেন খিলজী]।প্রাচীনকাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের গোটা সময়কালে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারত, তুরস্ক, পারস্য (ইরান), উজবেকিস্তান এবং পরবর্তীকালে ইউরোপ ও পাকিস্তানের নাম-যশ-খ্যাতি বিস্তারে ব্যতিব্যস্ত কতিপয় উচ্চাভিলাষী অভিজাত শ্রেণী বাংলা অঞ্চলকে বারবার দখল ও আধিপত্য বিস্তার করেছে। দখলদারদের নিয়োজিত সভাকবি বা ইতিহাসবিদদের লিখে যাওয়া বিবরণ অনুসরণ করে বর্তমানেও এক শ্রেণীর ইতিহাসবিদ ঐ সকল দখলদারেরই [দখলদার বোলে তো- মৌর্য রাজা, গুপ্ত রাজা, সেন রাজা, খলজী রাজা, হোসেন শাহ সুলতান, নবাব মুর্শিদ কুলী খান, বৃটিশ এবং পাকিস্তানি শাসক।] 'শ্রেষ্ঠত্ব' আর 'গৌরব'-এর ইতিহাস রচনা করে চলেছেন। [একদিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা যেমন আর্যদের ভুয়া 'শ্রেষ্ঠত্ব' আর 'গৌরব'-এর ইতিহাস রচনা করছে তেমনি অন্যদিকে আমাদের মোল্লা পাট্টি মুসলমান আক্রমণকারীদের ভুয়া 'শ্রেষ্ঠত্ব' আর 'গৌরব'-এর ইতিহাস রচনা করে চলেছে, মাঝখানে বলদ বনে আছি আমরা তথা সাধারণ মানুষ।]

 


যেখানে [ইতিহাসে] বাংলা ভূ-খণ্ডের সাধারণ মানুষের অর্জিত অভিজ্ঞতার বর্ণনা বলতে গেলে প্রায় পুরোটাই অনুপস্থিত। এইসব তোমরা যখন বড় হয়ে আরও বিস্তর পরিসরে ইতিহাস পড়বে, তখন জানতে পারবে। বুঝতে পারবে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এলিট শ্রেণীর অল্প কিছু মানুষ কীভাবে বারবার এই ভূ-খণ্ডের সাধারণ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের খেলায় মেতেছিল।"


এক কথায় অসাধারণ একটা পাঠ্যবই দেয়া হয়েছে। এবং এই প্রথম একেবারে মৌলিক ইতিহাস উঠে এসেছে। এতে আপত্তি জানাতে পারে কেবল দুই শ্রেণীর মানুষ। কট্টর মৌলবাদী হিন্দু টুন্নি এবং ছা????ল টাইপ মুসলমান।
সমস্যা হচ্ছে আমরা ইতিহাস পড়িই না। এই অজ্ঞতার কারনে ইতিহাস বইতে যখন হিন্দুত্ববাদের গন্ধ শোকার চেষ্টা করা হয় তখন দেখা যায় অনেক লীগারও তাতে সায় দিয়ে ফেলেন বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। আমার লেখাটা সেইসব লীগারদের জন্য যারা এখনও এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে হীনমন্যতায় ভুগছেন।


আমার মতে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে তাতে সরকারের হাতকে আমাদের শক্তিশালী করা উচিত। সতর্ক থাকা উচিত যাতে পিনাকীর মত নরকের কীটেরা মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা ছড়াতে না পারে।

 

 


নাজমুল হক রাজিব 
৯ই মাঘ ১৪২৯
[২৩শে জানুয়ারি ২০২৩]

Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক

খোলা-কলাম বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ