
ভারতবর্ষের ইতিহাস সাক্ষী আছে প্রথম ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করে ইংরেজিকে হারাম ফতোয়া দিয়েছিল কারা? ওরা সেই মোল্লা পার্টি যাদের ফতোয়ার কারনে মুসলিম তরুনরা কয়েক যুগ পিছিয়ে পড়েছিল।
ব্রিটিশ শোসনের যদি একটা ভালো দিক উল্লেখ করতে হয় তাহলে বলা যায় সেটা ইংরেজি ভাষা শিক্ষা- যা আমাদের সামনে মেলে ধরেছিল ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শনের বন্ধ দরজা। আধুনিক বিশ্বের সাথে সংযোগের মাধ্যম। যার অনেকটা ধনাত্মক প্রভাব পড়েছিল উনিশ শতকের গোড়ার দিকের বাংলা নবজাগরনে। গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ চলেছিল যাকে যথার্থই ইউরোপীয় ধারার নবজাগরণ বলা যায়। মুসলিম সমাজ সেই নবজাগরনে অনেকটাই মাঠের বাইরে ছিল মোল্লা পাট্টির ফতোয়া আর নিষেধাজ্ঞার কারনে। ফলে যেখানে জাতীয়তাবাদের বলে বলীয়ান শক্তিশালী একটি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেনী গড়ে উঠেছিল সেখানে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেনী ছিল আতুড়ঘরে। পরবর্তীতে স্যার সৈয়দ আহমেদের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা কিছুটা সাহায্য করলেও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো উত্থান মুসলমান মধ্যবিত্তদের মধ্যে তখনো দেখা যায় নাই। তবে শোনা যায় স্যার সৈয়দ আহমেদ কেবল আশরাফ শ্রেনীর প্রতি কিছুটা পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিলেন। উনার মতে আধুনিক উচ্চশিক্ষা কেবল মুসলিম আশরাফ অর্থাৎ উচ্চশ্রেনীর মুসলমান ঘরের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। আতরাফ বা নিচু শ্রেনীর মুসলমান তরুনদের সেই প্রাচীন প্রচলিত শিক্ষা ব্যাবস্থাতেই থাকা উচিৎ। [সৈয়দ আহমেদ আসলেই এই নীতি অনুসরণ করতেন কিনা সে ব্যাপারে এখনো তেমন শক্ত কোনো প্রমান আমি পাইনি।]
মজার কথা হচ্ছে সেই সময়ে মুসলীম সমাজের অশিক্ষার ব্যার্থতাকে ঢাকতে বর্তমান ফতোয়া পাট্টি সজ্ঞানে এবং আমরা অজ্ঞানে এখনো ত্যানা পেচাই। হিন্দুরা ইংরিজি শিখে ইংরেজদের গোলামে পরিনত হয়েছিল কিন্তু মুসলিম চির রণবীর(!) নাকি শৃঙ্খলার জিঞ্জির গলায় না পরে ইংরেজি বয়কটের মাধ্যমে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল। ইংরেজদের দালাল উল্লেখ করে আলীয়া মাদ্রাসা থেকেও মুখ ফিরিয়ে তারা ধরে বসে থাকলো কাওমী মাদ্রাসার মান্ধাতা আমলের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে। স্যার সৈয়দ আহমেদ বা মৌলানা আজাদদের মত পরহেজগার মুসলিম নেতারাও পারলেন না তাদের গোস্বা ভাঙাতে। কিসের গোস্বা? তিনারা নাকি শাসক ছিলেন। দীর্ঘ সময় ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুসলমানরা এবং তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনয়ে নিয়েছে ইংরেজ। তাই ইংরেজদের প্রতি তাদের গোস্বা। অন্যের প্রতি গোস্বা করে গাল ফুলিয়ে নিজের ক্ষতি সাধনকে আমরা মুসলমানরা আবার গর্ব করে প্রচারও করি। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি সেই সময় যখন জিন্নাহর মত মানুষ বক্তৃতা দিতে এসে হুংকার ছাড়তো মুসলমান তথা "আমরা ভারতবর্ষের শাসক ছিলাম" তখন দুই/একজনও কি ফিক করে হেসে দিতো না? কারণ জিন্নাহর বংশে তার বাবাই ধর্ম পরিবর্তন করে প্রথম মুসলিম হয়েছিলেন। সুতরাং যে মুসলিম শাসনকাল নিয়ে শাসক হিসেবে সে গর্ব করতো সেই শাসনকালে তার পূর্বপুরুষরাই ছিল হিন্দু। ব্যাপারটা তেমনই হাস্যকর যেমন মুঘল আমলের কোনো মুসলিম দর্জির বংশধর যদি ইংরেজ আমলে এসে মুঘল শাসক হিসেবে গর্ববোধ করে৷ শাসক তো ছিল মুঘলরা, তুই ব্যাটা ছিলি দর্জির পোলা, তুই কেনো গর্ব করছিস? করছে কারণ দর্জির পোলা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে।
আমাদের স্কুলে কাজী ইমদাদুল হকের লিখা "আবদুল্লাহ" নামের একটা উপন্যাস পড়ানো হতো ৭ম বা ৮ম শ্রেনীতে। সেই উপন্যাসটা আমি বার বার পড়তাম। (এককালে একই জিনিস বার বার পড়ার একটা উদ্ভট অভ্যাস ছিল আমার৷) আবদুল্লাহ উপন্যাসে তৎকালীন (১৯৩৩) মুসলমান তরুনদের শিক্ষার করুন দশা লেখক খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এখন বোধহয় উপন্যাসটা আর পড়ানো হয় না। অসাধারণ একটা উপন্যাস ছিল সেটা। গ্রামীণ মুসলিম সমাজের অতি কট্টর পর্দাপ্রথা, সম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পীরভক্তি, আশরাফ-আতরাফ বৈষম্য, হীন স্বার্থপরতা, ইত্যাদির বিরুদ্ধে মানবতাবাদী প্রতিবাদ চিত্রিত হয়েছিল উপন্যাসটিতে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর সামাজিক কুসংস্কার মুসলমান সমাজকে যে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল সেই ধ্বংসকে ইংরেজি শিক্ষায় সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে যে প্রতিরােধ করা যায় তা "আবদুল্লাহ" উপন্যাসে দেখানাে হয়েছিল।
তো যাই হোক, শুনেছিলাম গাধা পানি পান করে ঘোলা করার পর। কিন্তু ছা????লেও যে একই কাজ করে সেটা জানা ছিল না। ইংরেজি হারাম ফতোয়া দিয়ে মুসলামদের পিছিয়ে দেয়া সেই পীরপন্থী মোল্লা পাট্টি এখন ইংরিজি জ্ঞানের গরিমা দেখায়। যখন, যেখানে ইংরিজি শিক্ষার দরকার ছিল তখন সেখানে তা বন্ধ রাখার ফতোয়া দিয়ে যেখানে দরকার নাই সেখানে অহেতুক প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করাটা তাদের মানসিক দৈন্যতারই পরিচায়ক। বাংলাদেশের মাহফিল, শ্রোতারা সব বাঙালি আর এখানে চর্ম-নাইয়ের মেয়ের জামাই ঘোষনা দিয়ে ইংরিজি ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন! এর চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে?
নাজমুল হক রাজিব
৬ই মাঘ ১৪২৯
[২০শে জানুয়ারি ২০২৩]
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: