
দীর্ঘ প্রায় সাড়ে আট বছর পর শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে নয়টায় রাজধানীতে ওলামা মাশায়েখ সম্মেলনের আয়োজন করেছে "তথাকথিত" অরাজনৈতিক সংগঠনের দাবিদার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সেই সময় তারা মামাবাড়ির নতুন ৭ দফা আবদার ঘোষণা করে,
১. অবিলম্বে হেফাজত নেতাকর্মী ও আলেম ওলামাদের মুক্তি দিতে হবে। (বিশেষ করে ব্যাভিচারী মামুনুলকে।)
২. নেতাকর্মীদের নামে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। (মামা বাড়ির আবদার।)
৩. ইসলাম ও মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সংসদে আইন পাস করতে হবে। (যাতে যখন তখন যাকে তাকে গুস্তাখে রাসুলের অপবাদ দিয়ে পায়খানাস্তানের মত পিটিয়ে বা ফাসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা যায়।)
৪. কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। (এটা জামাতিদের আব্বু মৌদুদির পুরান আবদার। যখনই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার প্রয়োজন হতো তখনই মউদুদি এই দাবী তুলে কাদিয়ানীদের পাইকারি হারে প্যাদানী শুরু করতো। পায়খানাস্থানে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানো এবং হত্যার অভিযোগে ফাসির রায়ও দেয়া হয়েছিল মওদুদির বিরুদ্ধে। পরে তাদের বড় আব্বুজান সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে মৌদুদিকে পায়খানাস্থান সরকার ঝোলাতে পারে নাই। মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।)
৫. শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। (এইটা এক অদ্ভুত দাবী। ওরা কাওমী মাদ্রাসায় যা পড়ায় তার বিরুদ্ধে আমাদের কিছু বলার অধিকার নাই কিন্তু আমাদের সন্তানরা স্কুলে কি পড়বে না পড়বে তাতে তাদের নাক গলাতেই হবে। ওরা যে বিংশ শতাব্দীতে এসেও গোলাম-বাদীর মাসলা মুখস্ত করে তাতে কি আমরা আপত্তি করেছি কখনও?)
৬. জাতীয় শিক্ষা কমিশনে হাইয়াতুল উলিয়ার প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। (এতে কি উপকার হবে? হাইয়াতুল উলিয়া কি আমাদের শিক্ষার্থীদের হায়া বাড়াবে?)
৭. বিশ্ব ইজতেমায় বিতর্কিত মাওলানা সা‘দকে আসার অনুমতি দেওয়া যাবে না। (এটাও নতুন মামা বাড়ির আবদার)
সকালের সম্মেলনে এই দাবী তুলে বক্তারা বীরদর্পে সরকারকে হুমকি ধামকি দিয়ে ব্যাপক পরিমানে হাতি ঘোড়া মেরে গুষ্টি উদ্ধার করলেন। সারাদিন উদ্ভট অঙ্গভঙ্গিতে চিৎকার চেচামেচির পর ভরপেট খেয়ে হাল্কা ভাতঘুম সেরে বাদ আসর হেফাজত মহাসচিব শায়েখ সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল একখানা স্মারকলিপি এবং বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই বোগলদাবা করে চিপ-চাপ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে গেলেন গনভবনে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে আপত্তিকর অংশগুলো প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে তাদের দাবী পূরনের আবেদন করে খোশদিলে আবার তারা গনভবন ত্যাগ করলেন। ত্যাগকালে হেফাজত নেতা মাওলানা মীর ইদরীস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খুব ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা গুরুত্ব সহকারে শুনেছেন।"
সকালে সরকারের পিন্ডি চটকিয়ে বিকালেই সেই সরকার প্রধানের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনায় বসার মত বেহায়াপনার উদাহরণ কোনো রাজনৈতিক দলও আজ পর্যন্ত দেখাতে পারে নাই। সকালের হুমকিযুক্ত আদেশ বিকালে পরিনত হয় আকুল আবেদনে, গেলানো হয় অনুরোধের ঢেকি।
হেফাজতের বক্তাদের প্রত্যেকেই সারা দেশের মাঠে ময়দানে প্রতিনিয়ত তাফসীর মাহফিলের নামে সরকার বিরোধী প্রচারণা চালায়। প্রচুর ভিডিও এখনও ইউটিউবে আছে। সেই তারাই আবার সরকার প্রধানের কাছে আবেদন নিয়ে যায়। ২০১৮ সালে ৪ নভেম্বরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একই মঞ্চে উঠেছিল প্রয়াত হেফাজত আমির আহমদ শফীসহ আজকের এই কেন্দ্রীয় নেতারাই। কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে সেই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। এরাই সেই কাওমি জননীর সন্তান। এবার সামনে নির্বাচন, প্রতি নির্বাচনের আগে আগেই কিছু দান খয়রাত প্রতিবারই তাদের মাধ্যমে করা হয়। এবারও হয়ত কেউ কেউ রেলের জমি বা নগদ সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত হবেন। হলে অবাক হওয়ার কিছুই নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব ভালোভাবেই জানেন কাকে কখন কিভাবে কাজে লাগাতে হবে। তবে আমি অবাক হয়েছি আরেকটি তথ্য পেয়ে৷ সংবাদমাধ্যমে দেখলাম,
"চট্টগ্রামের জেলার বাসিন্দা হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনের (বীর বিক্রম) মাধ্যমে অতীতে নিজেদের দাবি জানাতো হেফাজত। তবে তিনি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মারা যাওয়ার পর সেই যোগাযোগে ভাটা পড়ে হেফাজতের। এরপর বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমেই সরকারের কাছে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করেন হেফাজত নেতারা।"
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বাচ্চু একজন "বীর বিক্রম" খেতাব প্রাপ্ত। চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলায় চুনতী গ্রাম ও ইউনিয়নে ১ জানুয়ারি ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করা চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী জয়নুল আবেদীন ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। ১৯৯৫-৯৬ সাল তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই একবছরের সার্ভিসে বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার জন্যে তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের খেতাবগুলোকে পরবর্তিতেও দেয়ার প্রথা চালু করেছিলেন যা সম্ভব জিয়াউর রহমান। খেতাব দিতে চাইলে অন্যনামে নতুন খেতাবের প্রস্তাব করা যেত। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের খেতাব কেন দিতে হচ্ছিল?
মুক্তিযুদ্ধের খেতাবের গুরুত্ব কমিয়ে সেটাকে সাধারনের কাতারে নামিয়ে আনার চেষ্টা হিসেবে পরবর্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে "সাহসিকতা" প্রদর্শনের পুরস্কার হিসেবে বীর বিক্রম খেতাব দেয়া শুরু করলে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হয়েছিল। ফলে নতুন খেতাব দেয়া বন্ধও হয়ে যায়। কিন্তু মোট কয়জন মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযুদ্ধের পদক পেয়েছিলেন তার কোনো তালিকা বা তাদের কোনো তথ্য আর প্রকাশ পায় নাই। শান্তিবাহিনী বিদেশী কোনো শক্তি ছিল না। আমাদেরই দেশের নাগরিক৷ নিজেদের অধিকার আদায়েই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। নিজের দেশের মানুষ মারার পুরস্কার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পদক বিতরন করা বি এন পি সরকার তখন (১৯৯৫-৯৬) ক্ষমতায়। আর নিজেদের মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে পুরস্কৃত করার মত নিরপেক্ষ মানসিকতা অন্তত খালেদা জিয়ার নাই। পাহাড়ী সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে "বীরত্বপূর্ণ সাহসিক" ভূমিকা রাখার জন্য ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হওয়া মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বাচ্চু ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান এবং হেফাজতের দাবী দাওয়া পেশ করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বস্তিকর না?
নাকি আমারই হজমে সমস্যা তাও ঠিক বুঝতে পারছি না।
তবে অন্তত এটা বুঝেছি মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের পদক প্রাপ্তদের খেতাব বাতিল করার যে একটা ক্ষীণ দাবি অতীতে তোলা হয়েছিল সেটা আর কার্যকর করা হয় নাই। এবং এক্ষেত্রে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানারও কোনো উপায় নাই। পত্রিকায় মরহুম মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বাচ্চুর নামের পর "বীর বিক্রম" লিখা না দেখলে আমারও হয়ত বদহজমের এই সমস্যাটা দেখা দিত না।
Daily J.B 24 / Nazmul Haque Bhuiyan
আপনার মতামত লিখুন: