
তানজিম হাসান সাকিব। বয়স সবে মাত্র ২০! ২০ বছর বয়স "সবে মাত্র" হয় না। এই দামড়ার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, আইনত সে তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। অভিষেক ম্যাচেই তার নজরকাড়া পারফরম্যান্সে বিমোহিত হয়ে যেমন গোটা দেশ তাকে মাথায় তুলে নেচেছে তেমনি তার টাইমলাইন ঘাটার পর গোটা দেশ তারে মাথা থেকে ফেলে দিয়েছে। সিম্পল ম্যাথ। এইখানে টাইমিং বোঝার তো কিছু নাই।
তার পোস্ট "কে বা কাহাদের দ্বারা" আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় নাই। তার টাইমলাইন খুললেই বোঝা যায় সে কি চীজ। তার ৯ এপ্রিলের পোস্টটা প্রথম ভাইরাল হয় যেখানে সে ১৯৫৪ সালের আপাদমস্তক আফগানী বোরখা পরা এক মহিলার ছবিকে বাংলাদেশের সোনালী অতীত হিসেবে উল্লেখ করেছে। সেটা সে করতেই পারে তার বাকস্বাধীনতা। কিন্তু এরপর আমাদের ডিজিটাল বিচ্ছুরা তার প্রোফাইল ঘেটে ঘেটে যে বিস্তর গু বের করেছে সেটা কোনোভাবেই তার বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে না। সেগুলো সে বিভিন্ন সময় নিজেই স্বপোদে হেগেছে। প্রোফাইল ঘাটাটা বিরাট পরিশ্রমের কোনো কাজ না। আমাদের বিচ্ছুরা জানে একজন ছা????ল কোন প্রজাতির পোস্ট দিতে পারে। তাই জানা কথা তার প্রফাইলে গিয়ে কিছু নির্দিষ্ট শব্দ লিখে সার্চ দিলেই পায়জামার গিট্টু খুলে যাবে। যেমন নারী, বিজয়, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, রাহবার, মুক্তমনা ইত্যাদি ইত্যাদি লিখে যে কারও প্রোফাইল সার্চ দিলে এ সম্পর্কিত আদি অকৃত্রিম পোস্টগুলো লেঞ্জা সমেত সামনে চলে আসবে।
এর বাইরে সে হাদিস কোরআন নিয়েও পোস্ট দিয়েছে যা আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক নয়। এখন সমস্যা হচ্ছে একটা পক্ষের হঠাৎ মনে হলো সাকিব সাহেব হাদিস কোরআনের বানী পোস্ট করেছেন দেখেই নাকি আমাদের প্রচুর জ্বলছে!
এটা এক প্রকার ইনফর্মাল লজিক্যাল ফেলাসী যাকে বলা হয়, "Moving the Goalpost".
এখানে মূল ইস্যু সাকিবের নারী বিদ্বেষ, বিজয় দিবস নিয়ে চুলকানী এবং সর্বশেষ জাতিয় সংগীত না গাওয়া। সেই মূল ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইসলামী পোস্টগুলোর দিকে। ইসলামী পোস্টগুলোকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে বকরিবাদীরা প্রশ্ন তুলছে,
"কেন ভাই? ফেসবুকে হাদিস শেয়ার করা কি অপরাধ? নিজ ধর্মের প্রতি সে ডিভোটেড হলে মুক্তমনাদের কী ঝামেলা?"
ওদের গোল পোস্ট এখন ইসলাম। সেখান থেকে আবার কোথায় Move করবে কে জানে। কেউ কি বলেছে ফেসবুকে হাদিস শেয়ার করা অপরাধ? কে বলেছে?
কোনো ক্রিকেটার ব্যাক্তিগতভাবে ধার্মিক হলে সেটা মোটেই আপত্তিকর কিছু না। যে রাধে সে অবশ্যই চুল বাধবে কিন্তু চুলের তেলের বিজ্ঞাপন করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারীরা খারাপ, চাকরীজীবি নারীরা খারাপ এসব মৌ ল বাদী বিজ্ঞাপন একজন ক্রিকাটার করবেন সেটা সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্য হওয়া উচিত না। নিজ ধর্মের প্রতি যে কেউ "ডিভোটেড" হলে আমাদের কোনোই আপত্তি নাই। আমাদের আপত্তি হবে তখনই যখন সে নিজ ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের ব্যাক্তিগত জীবন বিচার করে অবাস্তব সিদ্ধান্ত দিয়ে বসবে।
যেমন সে বলছে, "ভার্সিটির ফ্রি মিক্সিং আড্ডায় অভ্যস্ত মেয়েকে বিয়ে করলে আর যাই হোক, নিজের সন্তানের জন্য একজন লজ্জাশীলা মা দিতে পারবেন না!!"
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদেরকে এইভাবে বিচার করার অধিকারটা তাকে কে দিয়েছে? কেউ কি বলেছে এটা বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে? যেখানে আমাদের মা-বোন-বৌ রা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া।
তার মতে, নারী চাকরি করলে নাকি সমাজ নষ্ট হয়। বকরিটা ভুলে গেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। এখন আমরা কি ধরে নিবো তার বক্তব্য অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সমাজ নষ্ট করছেন? আমাদের জিডিপির একটা বড় অংশ রপ্তানী নির্ভর। তৈরি পোশাকের এই রপ্তানিখাতে লাখ লাখ নারী শ্রমিক প্রতিদিন শ্রম দিয়ে অর্তনীতির চাকা সচল রেখেছেন। এই বকরি তাদেরকেও অপমান করেছে। অবশ্য আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র এটাকে কোনো অপরাধ হিসেবে গন্য করে না। নারী বিদ্বেষ, বর্ণবাদ এগুলো আমাদের কাছে বিলাসজাত দ্রব্য৷ আপনি যদি বাংলাদেশের কোনো থানায় গিয়ে বর্ণবাদের নালিশ জানিয়ে বলেন, অমুক আমাকে কালু বলেছে। তাহলে পুলিশ উলটা আপনার পাছায় লাথি কষিয়ে হয়ত বলবে, "*****পুত তোরে কালু কইছে কারণ তুই আসলেই কাইল্লা তাই।" একই প্রতিক্রিয়া নারীবিদ্বেষের বেলাতেও হয়। "নারীর আবার বিদ্বেষ কি রে ভাই, কথাই তো বলেছে, গায়ে তো আর হাত দেয় নাই!" এবং এর সাথে জাতীয় সংগীতের ব্যাপারটা হয়ে গেছে আপেক্ষিক। "ভাই আমরা কয়জনই বা জাতীয় সংগীত শুনলে দাড়াই! তাই এইসব ছোটো খাটো ব্যাপারে কথা বলে একজন ভালো খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার নষ্ট করে দেয়ার কোনো মানে হয় না!"
মানুষের গায়ের রং নিয়ে যেমন ঠাট্টা করাটা ঘোরতর অন্যায় (পাশ্চাত্যে যেটা রীতিমতো অপরাধ) তেমনি জাতীয় সংগীত শুনে দাঁড়িয়ে না যাওয়াটা ঘোরতর অন্যায়। এখন দেশে বসে কিছু কুলাঙ্গার এই অন্যায়টা করছে বলে বিদেশে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সাকিবকেও জাতীয় সংগীতের প্রতি বিতৃষ্না দেখাবার লাইসেন্স প্রদান করার তো কোনো মানে দেখি না। মানে আমার পাশের বাড়ির হাকিম মিয়া জাতীয় সংগীত শুনে দাড়ায় না তাই সাকিব মিয়ার না গাওয়াতে তেমন কিছু আসে যায় না। প্রথমত পাশের বাড়ির হাকিম মিয়া আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে না, সাকিব মিয়া করছে। আর দ্বিতীয়ত গোটা স্টেডিয়াম গাইতে পারলে সাকিব কেন পারছে না?
এই না পারার গোড়ায় কি আছে? গোড়ায় আছে সালাফিজম।
বাংলাদেশে বর্তমানযুগে জাতীয় সংগীতকে নিয়ে সবচেয়ে কুৎসিত বক্তব্যটি দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ বিন ইউসুফ। জাতীয় সংগীতকে সরাসরি হারাম উল্লেখ করে দেয়া তার সেই বক্তব্য এখনো ইউটিউবে আছে। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যাবস্থা নেন নাই। কিছুই হয় নাই। চরমনাই পীর থেকে আব্বাসী হুজুর প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে বয়ান দিয়েছেন। আজকে যে সাকিবকে দেখা যাচ্ছে সে তাদেরই বিষের ফসল। জাতীয় সংগীত বিদ্বেষী আব্দুল রাজ্জাককে সে উস্তাদ উল্লেখ করে পোস্ট দিয়েছে। একমাত্র পাছায় ঘিলু নিয়ে ঘোরা মানুষদের পক্ষেই সম্ভব এইটা চিন্তা করা যে সেই আব্দুল রাজ্জাকের সাগরেদ হয়ে সাকিব মিয়া মনে মনে আসলেই জাতীয় সংগীত গাইছিলেন! তিনি মৌন সম্মান দেখিয়েছেন!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেন এগুলো নিয়ে একের পর এক পোস্ট দিচ্ছি? তার কারণ হচ্ছে আমরা তো এগুলো নিয়েই পোস্ট দেই। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওয়াজে বা ভিডিওতে করা স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী তথা বাঙালি জাতিয়তাবাদ বিরোধী যে কোনো বক্তব্যের প্রতিবাদ করি। সাকিব যে বক্তব্য দিয়েছে বা যে কাজ করেছে সেটা অন্যায় এবং প্রতিবাদযোগ্য। তার জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সে এখনো পর্যন্ত ক্ষমার ধারে কাছে যায় নাই উলটা আমাদের বলা হচ্ছে তাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে, কারন সে নাকি দুগ্ধপোষ্য এক দামড়া বালক!
ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্লাব ইয়র্কশায়ার দলে খেলতেন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ক্রিকেটার আজিম রফিক। তাকে উদ্দেশ্য করে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন তারই ক্লাবের সাদা চামড়ার ছয় ক্রিকেটার। গ্যারি ব্যালান্স, টিম ব্রেসনান, অ্যান্ড্রু গল, ম্যাথু হগার্ড, রিচার্ড পাইরাহ এবং জন ব্লেইন। সেই বর্ণবাদী মন্তব্য করার দায়ে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড ওরফে ইসিবির ক্রিকেট ডিসিপ্লিনারি কমিটি (সিডিসি) সেই ৬ ক্রিকেটার ও কোচকে নিষেধাজ্ঞাসহ জরিমানা করেছে এই বছরেরই মাত্র কয়েক মাস আগে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তানজিম হাসান সাকিবের বিষয়ে বিসিবি'র পদক্ষেপ আশা করাটা কি অনৈতিক হবে?
#বকরি_হটাও
নাজমুল হক রাজিব
Nazmul Haque Bhuiyan
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: