
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ মাস, বিশেষ তারিখ, বিশেষ ক্ষণকে টার্গেট করেই সকল চক্রান্ত ও আঘাত আবর্তিত হতে দেখেছি।
১। স্বাধীনতা যুদ্ধে হানাদার বাহিনী এই ডিসেম্বরেই আত্মসমর্পণ করে।
২। জুলফিকার আলী ভুট্টোর চাহিদা মোতাবেক কয়েকবার কয়েকটি তারিখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যার্থ হবার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের ভূখন্ডেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার। কিন্তু সেটা আগষ্টের ১৫ তারিখ বাস্তবায়ন হলো কেন? ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ই আগষ্ট বলে ?
৩। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগষ্টের ২১ তারিখেই হত্যার সিদ্ধান্ত কেন নিল পাকিস্তান?
ইতিহাস একটু দেখতেই হয় -
মূলত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মিশন শুরু হয় ১৯৭০ থেকেই। জুলফিকার আলী ভুট্টো জানতো বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তার ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সেই দিককেই সামনে এনেছিলো। বঙ্গবন্ধুর বিশাল জয় ভিত করে তোলে ভুট্টোকে। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, সেদিনই মিয়াওয়ালির কারাগারের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি গোয়েন্দা পুলিশের ক'জন কর্মকর্তার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরের দিকে একটি বিমানে যাত্রা শুরু করে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌছান। ওই বিমানেই দবির সিদ্দিকী নামে এক আততায়ীকে তুলে দেয় ভুট্টো। দবির সিদ্দিকী ছিলো মনে প্রানে একজন পাকিস্তানি। তার প্রতি ভুট্টোর নির্দেশ ছিলো লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকরার। লন্ডনের নিরাপত্তা বলয় অত্যন্ত শক্ত থাকায় দবির সিদ্দিকী তার কাজ শেষ করতে পারেনি।
এরপরে ভুট্টো দবির সিদ্দিকীর প্রতি ম্যাসেজ পৌঁছে দেয়, বঙ্গবন্ধুকে কলকাতায় গেলে সেখানেই হত্যা করার জন্য। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি জেনে যায় আগেই। সেই সুবাদে দবির সিদ্দিকী গ্রেফতার হয় কলকাতায়। বঙ্গবন্ধুর চাহিদামত দবির সিদ্দিকীকে তুলেদেয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশের হাতে। পরবর্তীতে জিয়া সেই দবির সিদ্দিকীকে শুধু মুক্তই করেনি, তাকে বানিয়েছিলো ঢাকা ক্লাবের সভাপতি।
ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ফরমেশন পরিবর্তন করে। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে ভুট্টো ঢাকা আসেন ১০৭ জনের বৃহৎ দল নিয়ে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলো সি আই এ কর্মকর্তা। এটাই ছিলো মারাত্মক একটা ভুল। বঙ্গবন্ধুর মনে কোন জটিলতা না থাকলেও ভুট্টো প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সকল পরিকল্পনা শেষ করে ফিরে যায়। ঐ বছরের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ভুট্টো এক ভাষণে বলেছিল, উপমহাদেশে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হতে চলেছে।
অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা?
জিয়া যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জড়িত নাই থাকে তাহলে ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যা করা হবে সেই বিষয় ৭৪ এর জুন মাসে ভুট্টো কিভাবে বলে উপমহাদেশে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হতে চলেছে?
সাংবাদিক জেড এ সোলেরি যিনি ভুট্টোর সাথেই বাংলাদেশে এসেছিলো তিনি ফিরে গিয়ে কিভাবে বলে - বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হতে চলেছে? তিনি কিভাবে বলে, বঙ্গবন্ধু যতোদিন থাকবে ততোদিন পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভাল হবে না। ঘটনা অতি দ্রুত গড়াতে থাকে, ১৯৭৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো-কিসিঞ্জারের বৈঠকের কথা সবাই জানে । সেই বৈঠকে ভুট্টো কিসিঞ্জারকে নিশ্চয়তা দেয় যে বঙ্গবন্ধু কিছুতেই টিকতে পারবেন না, এবং বাংলাদেশে সেনাশাসন হবে এবং সেই সেনাশাসন হবে ভারতবিরোধী।
পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর সরকারের কাছে ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট পাঠানো প্রতিবেদনে লিখেছিলেন যে ১৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার সারা দিন উদ্বিগ্ন হয়ে ঢাকার ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করছিল এবং সর্বক্ষণ পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে।
বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার খবর পাকিস্তানি মিডিয়া সবার আগে প্রচার করেছে অন্য কেউ জানার আগে। এমনকি খুনি ডালিম বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ম্যাসেজ প্রচার করার আগেই পাকিস্তান প্রচার করেছে।
পাকিস্তান তাদের মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যা সংবাদ প্রচার করে - অতি উৎসাহী হয়ে প্রচার করে "বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এবং শিগগিরই পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যাবে " ।
এ এল খতিব নামের এক পাকিস্তানি লেখক তাঁর ‘হু কিলড মুজিব’ বইতে লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা সেই বছরের জুন মাসে ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর আরো চাঙ্গা হয়। ’ তাঁর বইতে লেখা হয়েছে, কট্টর চীনপন্থী আব্দুল হক ১৯৭৪ সাালের ১৬ ডিসেম্বর ভুট্টোকে চিঠি লিখে অর্থ, অস্ত্র এবং ওয়্যারলেস পাঠাতে বলেছিলেন, যাতে মুজিব সরকারকে উত্খাত করা যায়। মার্কিন গবেষক স্টেনলি ওলপার্টের বই ‘ভুট্টোস লাইফ’-এ লিখেছেন, ভুট্টো তাঁর গোপন তহবিল থেকে কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে অকাতরে অর্থ দিতেন। স্টেনলি ওলপার্ট বাঙালি সাংবাদিক আব্দুল মতিনের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান নিশ্চয়ই মুজিব হত্যায় জড়িত ছিল। ’
এতসব ইতিহাস বলার উদ্দেশ্য হলো - পাকিস্তান বরাবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পক্ষের শক্তিকে হত্যা করতে চেয়েছে , আজো করে । ওরা চায় বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের সাথে মিশে যাক, প্রদেশ হিসাবে থাকুক । কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের শোক ওরা ভুলতে পারেনি । পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হতে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে এটা কিছুতেই পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি । যেহেতু বাংলাদেশ জন্মে ভারতের সরাসরি হাত রয়েছে , এবং দেশটি সনাতন ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে চলে তাই কট্টরপন্থী, উগ্র এই সাম্প্রদায়িক দেশটি কিছুতেই ভারতকেও মেনে নিতে পারেনা ।
যার ফলে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্যে দিয়ে প্রতিহিংসার পরিচয়তো পাকিস্তান দিয়েছেই , এবং বঙ্গবন্ধুকে নেপথ্যে থেকে হত্যাকারী খুনি জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলাদেশে । খুনি জিয়া মনে প্রানে পাকিস্তানি হবার কারনে বাংলাদেশে বপন করে গেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ । যা এখন বড় হয়ে চেপে ধরেছে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কে । শেখ হাসিনা সেই বঙ্গবন্ধুরই কন্যা । বাবার আদর্শে তিনি আদর্শবান।
একদিন ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে যে ভাবে ভয় পেয়েছিলো, আজও সেই একি ভাবে পাকিস্তানের পরবর্তি পজন্ম শেখ হাসিনাকে ভয় পায় । তাছাড়া পাকিস্তানকে পায়ের নিচে ফেলে শেখ হাসিনা যে ভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটা পাকিস্তানের হজম হবার কথা নয় । আর তাই আজ মির্জা ফকরুল ও তার দল বিএনপি সহ, প্রায় সকল ইসলামিক দল, ধর্মব্যাবসায়ী গ্রুপ , শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে । সুযোগ পেলেই তাদের প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন করবে । আর এই শক্তির পিছনে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান নামক জঙ্গি দেশটি ও পর্দার আড়ালে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্র । ২১শে আগষ্ট তার জ্বলন্ত উদাহরণ । প্রায় ২১ বার তার প্রাণ নাশের চেষ্টা বলে দেয় - পাকিস্তান বাংলাদেশে সরাসরি বসে না থাকলেও মির্জা ফকরুলদের হাত ধরে ধ্বংসাত্মক খেলায় মত্ত । ৭০ থেকে ৭৫ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সাথে ভুমিকা আরো ভয়ংকর ভাবে চলমান ।
আগষ্ট মাসটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্ত ঝরানোর মাস । এবার টার্গেট বিজয়ের মাস । আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্রগণ এই বিজয়ের মাসে আঘাত হানতে প্রস্তুত হচ্ছে ।
মোঃ তৈমুর মল্লিক
কলামিষ্ট
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: