
আপনারা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করবেন?
ভাল কথা।
আপনারা জশনে জুল্লুস করবেন?
আরো ভাল কথা।
আপনারা ওয়াজ মাহফিল করে মুমিন মুসলমানদের হেদায়েত করবেন?
অতি উত্তম প্রস্তাব।
চান্দা লাগবে?
নিয়ে যান। তাও দিলাম।
কিন্তু মাইকটা আমার বাস ভবনের দিকে কেন ফিট করতে হবে? আমি কি শুনতে চেয়েছি ভাইজান?
আচ্ছা আমার কথা বাদ দেন। যারা চাকরিজীবি, যাদেরকে সারা দিন অফিস করে আগামীকাল আবার অফিসে যেতে হবে তাদের কি হবে? তারা কি বলেছে কালকে আমরা ফ্রি আছি হুজুর আপনি গাইতে থাকেন? যারা অসুস্থ বা বৃদ্ধ তারা? রাসুল(সাঃ) কি বলেছেন এভাবে কেউ শুনতে চাক বা না চাক সবার কানে জোর করে হেদায়েতের বানী ঠেসে ঠেসে ঢোকাতে হবে?
যারা প্যান্ডেলে এসেছে তাদেরকেই শোনান না। কয়েকটা স্পীকারেই হয়ে যাবে। চোংগা মাইক লাগিয়ে আমার কানের পর্দা পর্যন্ত কেন আপনাদের পৌছাইতেই হবে ভাই? আপনারা তো আবার একই লয়ে হেদায়েত করতে পারেন না। গলার স্কেল ওঠে নামে। তার মধ্যে আতকা বজ্রকন্ঠে সম্মিলিতভাবে, "নারায়ে তাকবীর", " নারায়ে রিসালাত", "নারায়ে গাউসিয়া"...... ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলে হুংকার ছাড়ার মাজেজা বা শানে নযুলটাও আমার মাথায় ঢোকে না ভাইজান। তাকবীর ধ্বনি কাকে শোনাচ্ছেন? আল্লাহকে? রাসুল (সাঃ) এর শানে? আস্তে বললে আল্লাহ শুনবেন না? তাইলে মাইকের আগাটা সাত আসমানের দিকে ফিট করলে ভাল হইত না?
আর সবচেয়ে বড় সমস্যার ব্যাপার হচ্ছে এই বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়াটাও বিপদজনক। যেমনি বিপদে পড়ে গেছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি নাদের খান দম্পতি।
তো উনাদের অপরাধটা কি? অপরাধ হচ্ছে জনাব নাদের খান এবং তাঁর স্ত্রী হাসিনা খান ১৪ তারিখ চট্টগ্রামের পূর্ব নাসিরাবাদ শাহী জামে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি এবং অন্যান্য সম্মানিত সদস্যদের বরাবরে একটি দরখাস্ত পেশ করেন। দরখাস্তের মূল বিষয় হচ্ছে, "মাইক"। উক্ত এলাকায় কাছাকাছি দূরত্বে প্রায় ৮/৯টা মসজিদ আছে, আজানের সময় যাদের মাইকগুলো স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে "ফুল ভল্যিউমে" প্রায় একসাথেই বেজে ওঠে। খান দম্পতি মাইকের ভল্যিয়ুমটা কেবল কমাতে অনুরোধ করেছেন। ভোররাতে দূর থেকে ভেসে আসা সুমধুর আজানের ধ্বনি মনে কাব্যভাব উদয় করলেও যাদের বাসা মসজিদের ঠিক পাশেই তাদের প্রান হয় ওষ্ঠাগত। তার উপর আজান দেয়ার আগে মুয়াজ্জিন সাহেব মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে গলা পরিস্কার করার উদ্দেশ্যে যে গলাখাকারিটা দেন মাইকের কল্যানে সেটা বিকট শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসে। মোটেও আরামদায়ক কিছু না। হঠাৎ শুনলে মনে হয় কেউ যেন আমাকে ঠেসে হুজুরের গলার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং আমি হুজুরের থকথকে কফযুক্ত আল্বজিহবাটা ধরে দোল খাচ্ছি। নাদের খান দম্পতি স্রেফ মাইকের আওয়াজটা কমানোর অনুরোধ করেছেন, আযানের বিরুদ্ধে তো কিছুই বলেন নাই। তদের করা দরখাস্তে স্পষ্ট লেখা আছে, "শুক্রবারে মসজিদে মাইকের মাধ্যমে ওয়াজ করা হয়, আপনাদের অনুরোধ করেছি- এই আওয়াজ আপানারা মসজিদের ভিতরে রাখেন-"। মসজিদের মাইকে যে ওয়াজ বাজানো হয় সেই ওয়াজের আওয়াজ মসজিদের ভেতরে রাখতে বলা হচ্ছে। আযানের শব্দ তো মসজিদের ভেতরে রাখতে বলাই হয় নাই। তাছাড়া মসজিদের মাইকে ওয়াজ কেন শোনাতে হচ্ছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না৷
এদিকে নাদির খানের এক দরখাস্তে অনেকের অনুভূতি নিহত হয়ে গেছে। খান দম্পতি নাস্তিক, ইসলাম বিদ্বেষী, মুনাফেক, মুরতাদ ইত্যাদি ইত্যাদির ট্যাগ ইতিমধ্যে পেয়ে তো গেছেনই বোনাসে বুনো বরাহ শাবকের দল শিং বাগিয়ে তাদের পিছু নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে ওয়েব-জিহাদ। এবং একপ্রকার অবধারিতভাবেই চারপাশের প্রবল অনুভূতির সামাজিক চাপ সহ্য করতে না পেরে নাদির খান এবং তাঁর স্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে, মাফ চেয়ে আরেকখানা দরখাস্ত মহল্লা এবং মসজিদ কমিটি বরাবর লিখে আপাতত রেহাই পেয়েছেন। অবশ্য আগামী ঈদের জাকাত-ফিতরা দানের নির্দিষ্ট সময় না আসা পর্যন্ত তাদের ভোগান্তি শেষ হবে বলে মনে হয় না। এত বড় অপরাধের(!) শাস্তি তো তাঁদের অবশ্যই পেতে হবে। ৯০/৯৫/৯৮% মুসলমানের দেশ বলে কথা। "মুসলমান দেশ" উল্লেখে মনে পড়ে গেলো, অতীতে একই ধরনের অপরাধে সৌদি আরবের ইসলামিক এফেয়ার্স মিনিস্টার আব্দুল লতিফ আল-শেইখও অপরাধী ছিলেন। তাকে কিন্তু মাফ চাইতে হয় নাই।
https://www.aljazeera.com/.../saudi-minister-defends...
১ জুন ২০২১ সালে আল-জাজিরায় প্রকাশিত এই রিপোর্ট থেকে জানা যায় সৌদি সরকার মসজিদে লাউড স্পিকার ব্যাবহারের নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, "সব লাউডস্পিকার সর্বোচ্চ যত জোরে বাজানো যায় – তার এক তৃতীয়াংশ ভলিউমে বাজাতে হবে।"
অর্থাৎ স্পিকার ম্যাক্সিমাম ভলিয়্যুমের ওয়ান থার্ড পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এবার আজান হোক বা যাই হোক এই সীমা কেউ অতিক্রম করতে পারবে না। এব্যাপারে মন্ত্রী আবদুল লতিফ আল-শেইখ বলেন, "সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকে আসা অভিযোগ আমলে নিয়েই তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছেন।"
"The order was in response to citizens, complaints that the loud volume was disturbing children as well as the elderly."
অর্থাৎ সৌদি নাগরিকরাই অভিযোগ জানিয়েছিলেন লাউড স্পিকারের উচ্চ শব্দের কারনে শিশু এবং বয়োবৃদ্ধদের সমস্যা হচ্ছে।
একই অভিযোগ কিন্তু আমাদের নাদির খান দম্পতিও করেছেন। তাদের দরখাস্তে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- মসজিদের মাইকে ওয়াজ বাজানোর প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন, "অনেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার অসুবিধা হতে পারে, অসুস্থ লোকের অসুবিধা হতে পারে- অন্য ধর্মালম্বীদের বিরক্তির কারণ হতে পারে- সবচেয়ে বড় কথা বিকট আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বুঝা যায় না। আপনাদের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি- মসজিদুল হারাম, মসজিদুল নববী, ঐ সকল মসজিদে এই ধরনের মাইক ব্যবহার হচ্ছে কিনা খবর নেন।"
উনি খারাপটা কি বলেছেন? আরেকটা লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে সৌদি সরকার যেখানে "স্পিকারের" ভলিয়্যুম কমাতে আদেশ দিয়েছেন যেখানে বাংলাদেশের খান দম্পতি "মাইকের" ভলিয়্যুম কমাতে অনুরোধ করছেন। মাইক সৌদি আরবের মসজিদেও এখন আর ব্যাবহৃত হয় না। স্পিকারের চেয়ে মাইক বেশি পরিমানে শব্দ দূষণ ঘটাতে সক্ষম বলে অনেক দেশেই সেটা ব্যান করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইয়াহুদী-নাছাড়াদের প্রযুক্তি হওয়ার অপরাধে এককালে মাইক/মাইক্রোফোন মৌ-লোভীদের দ্বারাই হারাম ঘোষিত হয়েছিল।
তবে এটা ভাবারও কারন নাই যে সৌদি আরবেও এই আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয় নাই। রক্ষণশীল মুসলিম দেশটিতে কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশ সামাজিক মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। টুইটারে হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং শুরু হয়েছিল রেস্তোরা ও ক্যাফেগুলোতে উচ্চগ্রামে মিউজিক বাজানো নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে। আমাদের দেশেও ওয়াজ মাহফিলের মাইকের ব্যাপারে কিছু বললেই এক শ্রেনীর ছা????ল উদয় হন যারা ডিজে পার্টি, বিয়ে বাড়িতে উচ্চগ্রামে সঙ্গীত বাজানোর দিকে ইঙ্গিত করা শুরু করেন। নিজের অপরাধ হালাল করার যুক্তি হিসেবে অন্যের অপরাধকে উদাহরণ স্বরুপ টেনে আনার ব্যার্থ চেষ্টায় নেহাতই কিছু পুরনো কুযুক্তির নতুন করে অবতারনা হওয়া ছাড়া আখেরে লাভের লাভ আর কিছুই হয় না। আমরা সব রকম মাইক এবং পাব্লিক প্লেসে উচ্চগ্রামে যে কোনো কিছু বাজানোর বিরুদ্ধে। এবার সেটা মাহফিল বা ওয়াজ হোক, পূজা হোক বা বিয়ে বাড়ি অথবা হোক যানবাহনের হর্ণ বা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জয় উপলক্ষে দানবীয় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ। সব কিছুই একই প্রকারের অন্যায়ের মধ্যে পড়ে তবে সৌদি আরবে যতই বিরোধিতা হোক না কেন সৌদি সরকার শক্ত হাতে নাগরিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে স্পিকারের সাউন্ড কমিয়ে রাখতে বাধ্য করেছিলেন। সৌদি আরবের মত কট্টর ওয়াহাবী মতাদর্শনের দেশে যেটা সম্ভব হয়েছিল, বাংলাদেশের মত "ধর্মনিরপেক্ষ" রাষ্ট্রে সেটা সম্ভব তো দূর অনুরোধের সুরে আবেদন-নিবেদন করারও সাহস অনেকের হয় না। খান দম্পতির অবস্থা দেখে ভবিষ্যতেও কেউ আর সাহস করবে বলে মনে হয় না। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই রাষ্ট্রধর্মের লীলাখেলা!
নাজমুল হক রাজিব
৮ই পৌষ, ১৪২৯
[২৩শে ডিসেম্বর, ২০২২]
Daily J.B 24 / নাজমুল হক রাজিব
আপনার মতামত লিখুন: