
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট সকাল আটটা নাগাদ প্রায় 'একশ' জনের মত উত্তেজিত জনতা লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। ওরা সবাই প্রবাসী বাঙালি। ঢুকেই চিৎকার করতে করতে শুরু করলো ভাঙচুর। যে যা পাচ্ছে তাই ভাঙছে যেভাবে পারছে। আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকমিশনার কর্তৃক আহ্বান না করা পর্যন্ত বিধিমোতাবেক মিশন ভবনে ব্রিটিশ পুলিশের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে আক্রমণকারীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে ভাঙচুর চালালো।
টেবিল-চেয়ার, শেলফ-এর বই, দরজা জানালার কাচ আলমিরাহ কিছুই আর জায়গা মত নেই। দেয়ালে টানানো ছিল সদ্য নিহত প্রেসিডেন্ট মুজিব-এর ফটো। তার উপরই যেন আক্রোশটা বেশি। ছবির ফ্রেম ভেঙে একাকার করে একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার তখন জনাব ফারুক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর ভক্ত মানুষ বলে যথেষ্ঠ সুনাম তার আছে। এই তো মাত্র আড়াই বছর আগেই এই লন্ডনের এক হাসপাতালে বঙ্গবন্ধুর পেটের ‘এ্যাবসিস' অপারেশনের ঠিক আগ মূহুর্তে দাতকপাটি লাগিয়ে হাসপাতাল করিডোরে ভদ্রলোক ফিট হয়ে পড়ে গেলেন৷ পরে তিনি সবাইকে জানান "জাতির পিতার পেটে কীভাবে অস্ত্রোপচার হবে" সেটা চিন্তা করেই নাকি জনাব চৌধুরী অজ্ঞান হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কঠিন "ফ্যান" বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে এই মর্মে বিবিসির নিকট মন্তব্য করেছিলেন যে, "প্রেসিডেন্ট মুজিব হত্যার ফলে বাংলাদেশ ‘একনায়কত্বের' হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।"
তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে কর্মজীবনে ফারুক চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ সফলতা। তিনি একাত্তরের আগে অবিভক্ত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে কাজ করেছেন, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছেন, পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর স্বৈরাচারী জিয়াউর রহমান, স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সঙ্গেও কাজ করেছেন, এমনকি এর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনারও উপদেষ্টা হয়েছেন। মজার না ব্যাপারটা!
বর্তমানে অবশ্য ফারুক চৌধুরী আর বেচে নেই। উনার লিখা একটি বই মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’।
আর লন্ডনের হাইকমিশনার তখন ছিলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান। ডেপুটির নাম উচ্চারণ করে বিবিসি সংবাদ প্রকাশ করছে শুনে তিনি চিন্তা করলেন মিশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর কর্মকর্তা হিসেবে তারও কিছু একটা বলা উচিৎ। অফিসের তখন ভগ্নদশা। প্রবেশ করতে না পারলেও নিচের ফুটপাতেই তখন ঘোরাঘুরি করছিলেন গোটা চারেক রিপোর্টার। তাদেরকে ডেকে সাক্ষাৎকারের আদলে মন্তব্য জানিয়ে দিলেন হাইকমিশনার। ফলে দুপুরের পর থেকে রেডিও-টিভিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের মন্তব্য প্রচারিত হতে শুরু করল। ভাষা এবং প্রকাশ ভঙ্গী কিছুটা আলাদা হলেও হাইকমিশনারের মন্তব্যের মূল ভাব তার ডেপুটির বক্তব্যকেই সমর্থন করল। একনায়কের হাত থেকে মুক্তি, আহা মুক্তি!
হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতান ছিলেন একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। ঊনসত্তরের আইয়ুব-বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে আওয়ামী লীগে স্থান দিয়ে সত্তরের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের টিকিটে জয়যুক্ত করিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটেনের মতো জায়গায় হাইকমিশনার হিসাবে সৈয়দ সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন—সম্ভবত এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম 'অপরাধ'।
এই দুই ডাকসাইটে কূটনৈতিক ব্যাক্তিত্বের অধীনে থাকা লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে সেদিন দুপুরের লাঞ্চ-এর আগেই আরও একটি নাটকীয় ঘটনা সংঘটিত হলো।
সকালে যারা অফিস আক্রমণ করেছিল, তাঁদের ৫/৬ জন নেতা একটু বেলা বাড়লে আবার এসে হাজির হলো বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে তারা উত্থাপন করলো স্মরনকালের এক অদ্ভুত কুৎসিত দাবী৷
সকালে মিশন আক্রমণের সময় বিবিসি এবং আইটিভির ক্যামেরাম্যানরা ছবি তুলতে পারেনি। তাই মিশনের ভিতরে আরেক দফা ভাংচুর করা হবে এবং ছবি নেয়ার জন্য টিভি ক্যামেরাম্যান ও প্রেস ফটোগ্রাফারদের ‘এলাউ’ করতে হবে।
বিদেশের মাটিতে বসে নিজের দেশের মিশন অফিস ভাঙার নাটক ফটোশুট করতে দেয়ার আবদার মেনে নেয়া পৃথিবীর কূটনৈতিক ইতিহাসে আর আছে কি না সন্দেহ। এর চেয়ে চরম লজ্জাষ্কর ব্যাপার আর কিছু কি হতে পারে?
স্বল্পকালীন আলোচনার পর মিশনের কর্তৃপক্ষ অফিসের ভিতরে আরেক দফা ভাঙচুর-এর শুধু অনুমতি প্রদানই করলেন না, ভাঙা অফিস পূনরায় সাজিয়ে গুছিয়ে দিলেন যাতে ফটোশুটিং ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায়। নিহত প্রেসিডেন্ট, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফ্রেমওয়ালা ভালো, আধা-ভালো অনেকগুলো বড় ছবি এনে ডেপুটি হাইকমিশনারের বিরাট কামরার চারটা দেয়ালে টানানো হলো। টিভি ক্যামেরাম্যান আর প্রেস ফটোগ্রাফাররা ঘরের এক কোণায় ক্যামেরা বাগিয়ে ‘পজিশন' নিলেন। "একশন" আর মুখে বলতে হয় নাই অথবা শোনার জন্যও কেউ অপেক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করে নাই। আকস্মিকভাবে শুরু হয়ে গেল এক পৈশাচিক ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো তারা দেয়াল থেকে আছড়ে মাটিতে ফেলে প্রচন্ড আক্রোশে পা দিয়ে দাবিয়ে দাবিয়ে লাথি মারতে লাগলো। চেয়ার টেবিল উলটে আরেক দফা নাটক করা হলো। সাংবাদিকরা প্রানপনে সেই নাটক ক্যামেরাবন্দী করলেন।
বিকেল ৩টা নাগাদ বাংলাদেশ হাইকমিশনে সংঘটিত এসব ঘটনা প্রদর্শিত হলো বিবিসি ও আইটিভি টেলিভিশনে। সারা বিশ্ব দেখলো৷ উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। বহির্বিশ্বকে এটা জানান দেয়ার চেষ্টা যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ঘৃণা করে। লন্ডনের মত জায়গায় প্রবাসীরা তার হত্যাকান্ডে উল্লাস প্রকাশ করছে, দূতাবাসে ভাঙচুর চালাচ্ছে! তাদের এই ক্ষোভের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু শাসনামলে তার অত্যাচারে সাধারণ জনসাধারণ এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। Peeনাকি যেমন তার পোশা ছা????লগুলোকে কুযুক্তি শোনায়,
"চিন্তা করে দেখুন মনের ভেতর কতটা রাগ পুশে রাখলে মানুষ এতটা নিষ্ঠুরভাবে দেশের প্রেসিডেন্টকে স্বপরিবারে হত্যা করতে পারে! নিশ্চয়ই মুজিবের দোষ ছিল নাহলে এত নিষ্ঠুরভাবে মরতে হতো না। সুতরাং তার দোষ হচ্ছে ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ম্যাএএএএএএ………."
ছাগল গুলোও কাঠাল বন কাপিয়ে বলে ওঠে ঠিক ঠিক। তাদেরকে কে বোঝাতে যাবে যে, পৈশাচিকতা প্রকাশে পিশাচের কাছে কারণ থাকার দরকার হয় না। দরকার হয় কেবল উসিলার। খুনীর দলের কাছে উসিলার অভাব ছিল না।
লন্ডনস্থ বাংলাদেশি হাই কমিশনে ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনা বাঙালি জাতির ইতিহাসে আর এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এত চেষ্টা করেও সাধারণ বিদেশীদের চোখে বঙ্গবন্ধুকে তারা খারাপ বানাতে পারে নাই৷ উলটা এই হত্যকান্ড তাদের চোখে বাঙালি জাতিকে পরিনত করেছিল এক ঘৃণ্য পশুতে। এর একটা ছোট্ট কিন্তু প্রভাবশালী প্রমান পাওয়া যায় এম.আখতার মুকুল লিখিত, "মুজিবের রক্ত লাল" গ্রন্থে। উপরে বর্ণিত ঘটনাটির তথ্যও তার গ্রন্থ থেকে নেয়া। ভাঙচুর নাটকের তিনি ছিলেন কূটনৈতিক দায়িত্বে থাকা একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
তার লিখিত বইতে আরও একটি ঘটনার বর্ননা তিনি দেন যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় বিদেশীদের চোখে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা কতটুকু ছিল।
১৯৭৫ সালে অগাস্টের পর লন্ডনে কোনও এক ছুটির দিনে দোতলা বাসের সিটে বসে সদ্য পরিচিত হওয়া এক জ্যামাইকান ভদ্রলোকের কাছে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে আখতার মুকুল যখন উল্লেখ করলেন, তিনি বাংলাদেশের লোক অর্থাৎ বাঙালি। শুনে মুহুর্তের মধ্যে সেই জ্যামাইকান ভদ্রলোকের চেহারা থেকে কর্পূরের মতো সব হাসি উবে গেল। তাঁর চোখ দুটো যেন মুষলধারে বর্ষন করতে লাগলো কী এক নিদারুণ ঘৃণার বৃষ্টি!
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন জ্যামাইকান, “ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ? (আপনি বাংলাদেশের লোক) ইউ হ্যাভ ফ্রটালি কিলড শেখ মুজিব? (আপনারাই শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন?) আই হেইট টু টক্ উইথ ইউ। (আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে ঘৃণা বোধ করি) থুঃ থুঃ থুঃ থুঃ থুঃ……বলেই হুড়মুড় করে জ্যামাইকান ভদ্রলোক একেবারে বাস থেকেই নেমে গেলেন। হতভম্বের মতো বাসে বসে শুধু ফ্যাল্ ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন এম আর আখতার মুকুল।
১৯৭৩এর শেষভাগে, আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ'র এক পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থানে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দে যখন নিহত হলেন, ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এবং একই পরিনতি বরণ করতে হতে পারে'র সম্ভাবনা আচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "আমাকে মারতে চাস মার। কিন্তু তোরা কোনোদিন শান্তি পাইবি না।”
নাহ…..শান্তি ওরা বা আমরা কেউই পাই নাই….ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করে নাই। করবেও না। আর মুজিবের লাল রক্তে সিঞ্চিত বাংলাদেশের ইতিহাসে মুজিব লাভ করেছেন অমরত্ব। এজন্যই ‘মুজিবের রক্ত লাল'। পতাকার মাঝ খানের ঐ লাল বৃত্তের চেয়েও লাল।
নাজমুল হক রাজিব
৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯
(১৫/০৮/২০২২)
[তথ্যসূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল- এম আর আখতার মুকুল
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: