• ঢাকা
  • শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ; ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

ঢাকা  শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ;   ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

মৌলবাদ আইনকে ভয় পায়না, তার গতিপথ মাটির নিচ দিয়ে নিভৃতে - প্রকাশ ঘটে গগনবিদারী ধ্বংস দিয়ে

নাজমুল হক রাজিব 
Daily J.B 24 ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৭:৫৫ পিএম
মৌলবাদ ,  আইনক , গগনবিদারী ধ্বংস ,
প্রতীকী ছবি

 

গায়ের জোরে আইন করে মৌলবাদকে পরাজিত করা যাবে না, যায় না। এই চেষ্টা অনেকেই করেছিলেন। ইরানের শাহ থেকে শুরু করে আফগানিস্তান, সিরিয়া, মিশর এমনকি তুরস্কের কামাল আতার্তুক সবাই একসময় কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণ করে গেছেন।

 

জনসম্মুখে হিজাব বা ধর্মীয় সিম্বলযুক্ত যে কোন কিছু পরিধান করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মাদ্রসা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গায়ের জোরে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টাটা মৌলবাদী শক্তিকে বাধ্য করেছে এটা ভেবে নিতে যে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে৷ তাই তারা বাধ্য হয়েছে সর্বশক্তি নিয়ে মরনকামড় দিতে।ফলশ্রুতিতে এইসব জায়গায় মৌলবাদ বিবর্তিত হয়ে উত্থান ঘটেছে প্রাতিষ্ঠানিক জঙ্গীবাদের, যার ফলাফল আমাদের চোখের সামনে। ইরানের ক্ষেত্রে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে বাম ধারার রাজনৈতিক শক্তি সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে সখ্যতা গড়েছিল মৌলবাদী শক্তির সাথে। দুইপক্ষ মিলে শাহের সিংহাসন উলটে দেয়ার পর পর আয়াতুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতা হাতে নিয়েই সবার আগে কচুকাটা করেছিলেন তার এককালের সহযোদ্ধা বামদেরকেই। বাংলাদেশের বামরা যখন জামাতের সাথে অথবা মৌলবাদীদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলে তখন  ইরানের কথা মনে করেই আমার হাসি পায়। 


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সেই কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতাকে অনুসরণ না করে সফট ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হেটেছেন। সেই সময় স্বাধীনতা বিরোধীরা এটা প্রচার করেছিল যে বঙ্গবন্ধু ভারতের চাপে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন, যেটা নির্জলা মিথ্যাচার। অবশ্য কিছু, এখনো সেটাই বিশ্বাস করে থাকে।


বঙ্গবন্ধু আশাবাদী ছিলেন, ভরসা রেখেছিলেন তার প্রানপ্রিয় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর, যার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। আমরা স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় পিতৃহত্যায় উন্মত্ত হলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরীর সুবিধার্থে জনসম্মুখে আসার মাধ্যম হিসেবে একটা গোষ্ঠী কাজে লাগিয়েছিল ইসলামাইজেশনকে।


ইসলামী ফাউন্ডেশন সৃষ্টির ফলে ইসলামের কোন উপকার হয়েছিল কিনা জানি না তবে ইতিহাস সাক্ষী সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা জামাত/শিবির/রাজাকারেরা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসলে কে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, কে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল এমনকি কে আওয়ামী লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিল সেগুলো মাথা থেকে আগে ঝেড়ে ফেলতে হবে। না হলে প্রচন্ড বিস্ময়ের ঠ্যালায় জাগতিক বুদ্ধি লোপ পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

এই যেমন, কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের অভ্যন্তরে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত (১৯৬১ খ্রি.) 'ইসলামিক একাডেমি'কে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে 'ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ' নামান্তর করে বঙ্গবন্ধু এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত করেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে। ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সভাপতি ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আশির দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অবধি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অথচ সেই আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং মোশতাক সরকারের প্রশংসা করে বলেন, “প্রেসিডেন্ট মোশতাকের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক দেশে আইনের শাসন, শান্তি এবং সুখ প্রতিষ্ঠার জন্য।"
[Who Said What After August 15- Daily Star Sun Aug 17, 2014]


তাছাড়া পচাত্তরের পর থেকে ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত কিতাবগুলো খেয়াল করলেও বুঝতে পারা যায়। সরকারী খরচে মওদুদির কিতাব বাংলাদেশে আর কারাইবা প্রকাশ করতে চাইবে!
চুয়াত্তরে কবি দাউদ হায়দারকে নাস্তিক বানিয়ে দেশ ছাড়া করে আস্তিকতার কি উপকার হয়েছিল আমি জানি না, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী এই সুযোগে নাস্তিক নিধনের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেশবাসীর কাছে নিজেদেরকে গ্রহনযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছিল কোনো একটি তথাকথিত অরাজনৈতিক গোষ্ঠী। 


৭৪এ লাহোরে অনুষ্ঠিত ও আই সি'র সম্মেলনে যোগদানের পর প্রটোকল মেনে যখন বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়ে ভুট্টোকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রন জানিয়ে দেশে ফিরে এলেন, সবার আগে তাকে অভিনন্দন জানানাে হয়েছিল সেই তথাকথিত অরাজনৈতিক গোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে। অবশ্য এর আগে থেকেই বাংলাদেশে অহেতুক ভারত বিদ্বেষের মচ্ছব লাগিয়ে দেয়া হয়। তাদের দাবি অনুযায়ী, যেহেতু ভারতই আমাদের প্রধান শত্রু এবং চারপাশ স্থলভাগের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকার দরুন তাদের দিক থেকেই আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি তাই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত ভারত-রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে মুসলিম উম্মাহর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে পা কিস্তা নের সাথে আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করা উচিত।


একই সুর পা কিস্তা নেও শোনা যেতে থাকে। ভুট্টো সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, "আমাদেরকে অতীতের সুখদায়ক অংশটুকুই শুধু স্মরন রাখা উচিত।" [বাংলার বানী ১৯৭৪, ২৪শে ফেব্রুয়ারী।]
সে সময়ের ইত্তেফাকে প্রকাশিত সম্পাদকীয়গুলো পড়লেই বোঝা যায়, ইনিয়ে বিনিয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধতার পক্ষে কিভাবে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। অথচ তখনও পর্যন্ত সৌদি আরব বাংলাদেশকে সীকৃতি দেয় নাই। চারিদিকে যেন মুসলিম জাতিয়তাবাদ এবং ভাতৃত্ববোধের একটা জোয়ার উঠেছে। সেই জোয়ারে কারা তরী ভিড়িয়েছিল সেই সাক্ষ্যও কিন্তু ইতিহাস দিচ্ছে।


বঙ্গবন্ধু তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরবর্তী প্রায় পাঁচ হাজার একর সুবিশাল জায়গা বরাদ্ধ করে দেন। সেই সাথে কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণ করে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের আবাসন ও ইসলামি দাওয়াতি কাজে সফররত তাবলিগ কর্মীদের কার্যপরিচালনার জন্য সুব্যবস্থা করে দেন। শুধু তাই না, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার ফলে ইসলামের কি উপকার হয়েছিল আমি জানি না, তবে ইতিহাস সাক্ষী আবহমান কাল ধরে এই তাবলিক জামাতকে নিজেদের কর্মী বাছাই এবং প্রাথমিক দীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যাবহার করে এসেছে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামাত ই ইসলাম। দাদা রাজাকার গো আ'র মতে জামাতের সকল কর্মীর একবার হলেও চিল্লায় যাওয়া উচিত, সে নিজেও অনেকবার গিয়েছে। [গোআ'র আত্মজীবনী, "জীবনে যা দেখলাম"]
এতকিছু করেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হিন্দু ঘেষা বা ইসলাম বিদ্বেষীর মিথ্যা তকমাটা ঝেড়ে ফেলা গেলো না। বরং তা দিন দিন আরও বাড়লো।


ডঃ নজরুল ইসলাম, তার বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বইতে উল্লেখ করেন, "বিশ্বের মোট বাঙালির অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এঁরা সাহিত্যের মধ্যে, সংস্কৃতির মধ্যে, রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন— 'আপনি বাঙালি না মুসলমান?' যেন বাঙালি ও মুসলমান হওয়া পরস্পর বিরোধী। যেন মুসলমান হলে বাঙালি হওয়া যায় না।" (নজরুল ইসলাম, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫।)
ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই একটা অযৌক্তিক বিষাক্ত প্রশ্ন তো আমাদের পিছু ছাড়লো না। সেই প্রশ্ন বিবর্তিত হয়ে নতুন মুখ দিয়ে নতুনভাবে বের হলো, "আপনি আওয়ামীলীগ নাকি মুসলমান?" 
পচাত্তরের পর থেকে আশি নব্বইর দশকে জামাত/শিবির বা সম মতাদর্শের মানুষদের কাছ থেকে এই প্রশ্ন একবারও শোনে নাই এমন আওয়ামী লীগের নেতা/কর্মী বা সমর্থক খুজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। সেই প্রশ্নের সর্বশেষ আধুনিক ভার্সন হচ্ছে, "ব্যাক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়, দেশের চেয়ে ধর্ম বড়।"


দুঃখজনক হলেও সত্যি এই তত্ত্বের প্রভাবেই লীগের কিছু অংশের মাথায় সৃষ্টি হয়েছে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। তাদের দুশ্চিন্তা ৯০% বা ৯৫% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে যদি নিজেদেরকে ইসলাম পসন্দ হিসেবে প্রমান করা না যায় তাহলে হয়ত জনসমর্থন হারাতে হতে পারে। রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখা বা ধর্মের ব্যাবহার না করাটা কেন মঙ্গলজনক অথবা সেটাই যে ধর্মনিরপেক্ষতার কোর কনসেপ্ট, জনগনের সামনে সেই ব্যাখ্যাটা না রেখে সবাই প্রতিযোগিতায় নামলো নিজেদেরকে ইসলাম পসন্দ মুসলমান প্রমানে। তার লেজ ধরেই এখনো আওয়ামী লীগের অনেককে বলতে শোনা যায়, "আমি আগে মুসলমান তারপর বাঙালি।" অথচ এই তুলনামুলক ত্বত্তটি ততটাই অযৌক্তিক যতটা অযৌক্তিক হচ্ছে এই প্রশ্ন তোলা যে, "আপনার ফুসফুস আগে নাকি হার্ট?" যেখানে এর একটি ছাড়া অপরটি কোন কাজেই আসবে না।


তাই আজকে যারা লীগের ভেতরে থেকে চিন্তা করছেন লীগের উচিত বেশি বেশি ইসলামের বা ধর্মের খেদমত করা যাতে মানুষ বুঝতে পারে আওয়ামী লীগ ইসলাম পসন্দ বা ইসলামের শত্রু না, তাদের জন্য রইলো আমার একরাশ শুভকামনা। বঙ্গবন্ধুর আমলেও আওয়ামী লীগের একটা ডানপন্থী অংশ ইসলাম খেদমতের শোডাউন করার এই ধুয়া তুলেছিল। চেষ্টা তখনো করা হয়েছিল, ফল তো হয়ই নাই উলটা সেই চেষ্টা ঘাতকদের হাতকেই শক্তিশালী করেছিল। তারা তার সুবিধাটা নিয়েছিল শতভাগ। আশাকরি এবার হয়ত আপনারা সফল হবেন আওয়ামী লীগকে ইসলাম পসন্দ রাজনৈতিক দল হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে! নাহয় যতগুলো মসজিদ/মাদ্রাসায় সরকারী অনুদান যাচ্ছে অথবা সরকারী খরচে যতগুলো মসজিদ করে দেয়া হচ্ছে সেগুলো খুব সহজেই পরিনত হবে জামাত-হেফাজতের আশ্রয় এবং প্রচার কেন্দ্রে। সেদিকে নিশ্চয়ই আপনাদের লক্ষ আছে৷ ঠিক কিনা হাজেরানে মজলিস? চিল্লায়া কন।

 


নাজমুল হক রাজিব 
৬ শ্রাবণ ১৪২৯ 
(২১/০৭/২২)

Daily J.B 24 / সোশ্যাল মিডিয়া

খোলা-কলাম বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ