
ঐ এলাকার বাসিন্দা অমিত শিকদার বলেন, ‘অধ্যক্ষ স্বপন বাবু একজন ভদ্র প্রকৃতির লোক। গ্রামের কোনও লোকের সঙ্গে কখনও তাকে দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। তার অপমানে আমরা হতবাক হয়েছি।’
একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, ‘কয়েকজন কলেজ ও মাদ্রাসা ছাত্রের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। সময়তো পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ঘটনাস্থলে এলে ঘটনা এতদূর যেতো না। ওই শিক্ষকের অবমাননা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চাই।’
সেই শিক্ষক কোথায়?
অধ্যক্ষের স্ত্রী সোনালি দাস বলেন, ‘গত ১৮ জুন কলেজে অপ্রীতিকর ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটার পর আমার স্বামীকে সেফ কাস্টডিতে নিয়ে যায় পুলিশ। পরদিন পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে তিনি আর বাড়িতে আসেননি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।’
ঘটনার পর তারা কোনও ধরনের নিরাপত্তাহীনতা কিংবা হুমকিতে রয়েছেন কিনা– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ি সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারায় রয়েছে। কেউ কোনও ধরনের হুমকি দেয়নি। তবে ঘটনার পর থেকে পুরো পরিবার সদস্যরা বিমর্ষ।’
স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাবা সুমন্ত বিশ্বাস বলেন, ‘আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে যারা অপমান-অপদস্থ করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
ফেসবুকে ছাত্রের দেওয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে সেদিন পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সামনে কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে। পরে তাকে সেফ কাস্টডিতে নিয়ে যায় পুলিশ। পরদিন পুলিশ ছেড়ে দেয়। এরপর আর বাড়িতে ফেরেননি শিক্ষক। তার মোবাইল নম্বর বন্ধ রয়েছে। এখন তিনি কোথায় আছেন জানেন না স্ত্রী-সন্তানরা।
সবাইকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়
সবাইকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়।
পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কীভাবে একজন শিক্ষককে এভাবে অসম্মান করা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেননি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের দুই শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ‘১৭ জুন রাতে কলেজের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে ভারতের রাজনীতিবিদ নূপুর শর্মাকে সমর্থন করে একটি পোস্ট দেন। ১৮ জুন সকালে ওই শিক্ষার্থী কলেজে আসেন। তখন সহপাঠীরা তাকে পোস্টটি মুছে ফেলতে বলেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয় সহপাঠীদের। পরে বিষয়টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জানান। তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের বলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত তোমরা বিশৃঙ্খলা করো না, শান্ত থাকো। এতে তারা ভেবেছিলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্যার হিন্দু হওয়ায় বিচার পাবেন না। ফলে কয়েকজন শিক্ষার্থী বিক্ষুব্ধ হন। কলেজ থেকে বেরিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী এলাকাবাসীকে বিষয়টি জানিয়ে দেন। এ খবর চলে যায় পাশের মির্জাপুর হাজীবাড়ি দাখিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে সংঘবদ্ধ হয় এলাকাবাসী। দুপুরে ওই ছাত্রের বিচার দাবিতে কলেজ প্রাঙ্গণে জড়ো হন তারা।
এ অবস্থায় শিক্ষক ও স্থানীয় গণ্যমান্যদের নিয়ে বৈঠক করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। বৈঠকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে বাইরে অপেক্ষারত শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতার মাঝে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে কলেজে ভাঙচুর চালানো হয়। এভাবেই ঘটনার সূত্রপাত।’
স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সকালে কয়েকজন ছাত্র ঘটনাটি জানালে আমি তিন শিক্ষককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের মধ্যে ছিলেন- কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম, পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য ও কৃষি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক কাজী তাজমুল ইসলাম এবং স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।
তিনি আরো বলেন কলেজে কোনো অঘটন ঘটলে আমি সবার আগে এই তিন শিক্ষককে জানাই। প্রতিবারের মতো সেদিনও তাদের জানালাম। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকতে বললাম। দুপুরে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়, আমি ওই ছাত্রকে সাপোর্ট করেছি। তখন কিছু ছাত্র ও এলাকাবাসী মিলে কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
একপর্যায়ে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ও পাশের একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। তখন আমি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পুলিশকে ফোন করে ডেকেছি। তবে কেউ সময়মতো আসেননি।
পরে পুলিশ এলে জড়ো হওয়া লোকজনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। আমার সহ শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ এসে আমাকে বলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনাকে পুলিশের হেফাজতে নিতে হবে। তখন আমি পুলিশের কাছে একটি হেলমেট ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট চাই। তবে আমাকে হেলমেট দেওয়া হয়নি। একটি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট দেওয়া হলেও পরে তা পুলিশ খুলে নেয়। পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত মানুষ, পুলিশ ও ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনে জুতার মালা পরিয়ে দিলো।
জানেন ওরা আমাকে পুলিশ ভ্যানের কাছে নেওয়ার সময় পেছন থেকে অনেকে আঘাত করেছে। আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় পা কেটে যায়। তখন অনুভব করি, পেছন থেকে কেউ আমার মাথায় আঘাত করেছে।
এসব দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকটা অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। লজ্জায় আত্মহত্যা করতে মন চাইচিলো তখন।
মঙ্গলবার (২৮ জুন) সরেজমিনে স্বপন কুমার বিশ্বাসের বড়কুলার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, স্ত্রী, তিন সন্তান এবং বাবা-মা বাড়িতে আছেন। বাড়িতে পাহারা দিচ্ছেন তিন পুলিশ সদস্য। পরিবারের সদস্যরা বিমর্ষ। অধ্যক্ষ কোথায় আছেন বলতে পারছেন না তারা। সেদিনের ঘটনার বিষয়েও কোনও কথা বলতে রাজি হননি কেউ অজনা ভয়ে।
সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু, বিছালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিমায়েত হোসাইন ফারুক, কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অচীন কুমার চক্রবর্তী, সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাহমুদুর রহমান, এসআই মোরসালিন, ওই এলাকার বাসিন্দা অমিত শিকদার ও আব্দুল আলীম।
পরে ঘটনাস্থলে যান নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক, জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীর।
আক্তার হোসেন টিংকু বলেন, ‘জুতার মালা পরানোর ঘটনাটি আমি দেখিনি। ওই সময় সেখানে পুলিশ ছিল। তারা ভালো বলতে পারবে। আমি কলেজের শিক্ষার্থীদের থামাতে চেয়েছিলাম। সে সময় আমার গায়ে বেশ কয়েকটি ইট-পাটকেল পড়েছে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি চাই আমিও।’
চেয়ারম্যান মো. হিমায়েত হোসেন ফারুক বলেন, ‘ঘটনা যখন বেগতিক তখন সেখানে গিয়েছিলাম। চেষ্টা করেও স্থানীয়দের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় যারা জুতার মালা পরিয়েছে তাদের ধিক্কার জানাই। ঘটনার পেছনে যাদের ইন্ধন রয়েছে, তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।’
অচীন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘একটি মহল পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তুলেছিল। এখানে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইস্যু থাকতে পারে। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি তদন্ত করছে। তারা প্রতিবেদন দিলে আসল ঘটনা জানা যাবে।’
সদর থানার পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষককে লাঞ্ছনা, কলেজে ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ওই এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
এসআই মোরসালিন বলেন, ‘শিক্ষককে অবমাননা ও কলেজে ভাঙচুরের ঘটনায় সোমবার দুপুরে আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। মামলায় শাওন (২৮), সৈয়দ রিমন আলী (২২) ও মনিরুল ইসলাম রুবেল (২৭) নামে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।’
ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর বলেন, ‘অধ্যক্ষের কোনও অপরাধ না থাকায় তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন আর প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তে কাজ চলছে। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। বর্তমানে কারাগারে আছে। কলেজে ও ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা আছে।’
সবার সামনে কীভাবে এমন ঘটনা ঘটলো জানতে চাইলে এমপি কবিরুল হক বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক একটা ঘটনা এখানে ক্যানসার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজিত জনতা যেন আবারও উত্তেজিত না হয়, সে চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও স্থানীয় মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তুলেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ওই শিক্ষকের অবমাননা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে একজন শিক্ষককে অসম্মান করা হলো জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘ঘটনার দিন কলেজ প্রাঙ্গণের পরিস্থিতি খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল। পুলিশ সেখানে চেষ্টা করেছিল বিনা রক্তপাতে পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। অধ্যক্ষকে যখন কলেজের কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়, তখন সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এছাড়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। তখন কেউ তাকে জুতার মালা দিয়েছে কিনা আমরা দেখতে পারিনি। এটা আমার জানা নেই।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীকে। বাকি দুজন হলেন- জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান ও নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর। কমিটি ৩০ জুন প্রতিবেদন জমা দেবে। সার্বিক পরিস্থিতি প্রশাসনের নজরদারিতে রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে শিক্ষককে অবমাননাসহ তিনটি ধারায় নিয়মিত মামলা হয়েছে। তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার জড়িত অন্যদের শনাক্তের কাজ চলছে। শিক্ষকের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি এখন স্বাভাবিক রয়েছেন। কলেজটি ঈদুল আজহা পর্যন্ত বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: