
পর্বঃ এক
সারাদেশ জুড়ে লোডশেডিং-এর কারণে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে! ব্যাহত হচ্ছে কলকারখানায় উৎপাদনে। বিপর্যয় রোধে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী এবং অবৈধ সংযোগকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত সচেতন নাগরিক সমাজ।
নামাজের সময় ব্যাতীত অন্য সময় পবিত্র মসজিদ সহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে এসি বন্ধ রাখার অনুরোধকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু মূলধারার গণমাধ্যমে বিকৃত ভাবে প্রকাশিত এবং মেইনস্ট্রিম টিভি-চ্যানেলে বক্তব্যেকে বিকৃতরূপে সম্প্রচারের ফলে সোস্যাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গুজব। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ চলমান থাকায় পৃথিবীজুড়ে চলা এক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ মিতব্যয়ী এবং উত্তোরণের জন্য বিকল্প পথ খুঁজছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানান। এতোকিছু হচ্ছে বা ঘটছে কিন্তু তারপরেও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ থেমে নেই! গোটা রাজধানী জুড়েই বিদ্যুৎতের অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি। ব্যাটারিচলিত অটোরিক্সা গ্যারেজ, কারখানা, জেনারেটর সংযোগের নামে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে সবচেয়ে বেশী অবৈধ সংযোগের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। জানা যায়, স্বয়ং বিদ্যুৎ অফিসের কতিপয় অসাদু বিদ্যুৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের দলীয় পরিচয়ে এলাকার পাতি নেতা, লোকাল হলুদ সাংবাদিক এবং থানার পুলিশের কতিপয় অসাদু সদস্যের সিন্ডিকেট জড়িত এসব অবৈধ সংযোগ প্রদানে। বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ প্রদানে এলাকা ভিত্তিক একেক রকম একেক রেটে সংয়োগ দিয়ে থাকে এই সিন্ডিকেট। সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত সংযোগ ফি নিয়ে থাকে সিন্ডিকেটটি। এছাড়াও মাসিক পাঁচশত টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বিল নেয় এ সিন্ডিকেট। কেউ টু শব্দ করলেই এলাকার পাতিনেতার পরামর্শে হলুদ সাংবাদিকরা ভয় দেখায়, বিদ্যুৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর পুলিশ এসে আটকের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যে করে বসে এমন তথ্যও পাওয়া যায়।
শুধু মিরপুর-১০ নাম্বার এলাকায় কাফরুল থানা রোডে হোপ স্কুল এলাকায় সাবেক যুবদল নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী বর্তমানে যুবলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে জীবন নামের একজন হোপের তিনশ দোকানের অবৈধ বিদ্যুৎ বিল ও ফুটপাত থেকে তার উত্তোলিত চাঁদার পরিমান বিশ লক্ষ টাকার উপরে বলে জানা যায়।
আদাবর-১৬, ১৭ নাম্বারে শাহীন নামের আরেক যুবলীগের ইউনিট কর্মী জেনারেটরের নামে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, রাজধানী জুড়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার সংখ্যা লাখের উপরে। অধিকাংশ অটোরিক্সার গ্যারেজেই মাসিক মাসোয়ারায় বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ চলমান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন টোকেন দাতা জানান, ঢাকা -১৬ আসনে আমি সাত হাজার রিক্সার মাসিক টোকেন দিতাম। প্রতিটি টোকেন বাবদ মাসিক পনেরো শত টাকা নির্ধারণ ছিলো। এটা আমরা আর থানায় যেতো। বিদ্যুতের সাইটটা আরেকজন দেখে। শুধু ঢাকা-১৬ আসন এলাকার অটোরিকশা গ্যারেজ থেকেই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে প্রতি মাসে দশ লক্ষ টাকা বিদ্যুৎ অফিসে নিতেন বলে তিনি দাবি করেন। এছাড়াও, উত্তরা দিয়াবাড়ি খালপাড়, দক্ষিণ খান, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, ঢাকা উদ্যান, একতা হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং ২য় প্রকল্প, নবোদয় বাজার, শেখের টেক-৬, ৭, ৮, আদাবর-১০, হাক্কাপাড় এলাকা, সুনিবিড় হাউজিং বালুর মাঠ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানের জায়গায় গড়ে উঠা সিটি কলোনী, চিড়িয়াখানা রোড, মিরপুর-১০, ভাসানটেক, লালমাটিয়া, মানিকদি এবং কড়াইল বস্তিতে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের সংখ্যা বেহিসেবী বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা যায়। এসব স্থানে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার গ্যারেজ, জেনারেটরের সংযোগ বলে অন্য লাইনের বিদ্যুৎ অবৈধভাবে সরবরাহ এবং ফুটপাতের দোকানে অবৈধ সংযোগ রয়েছে।
এছাড়াও- পোস্তগোলা, শ্যামপুর, জুরাইন, কদমতলী, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, কামরাঙ্গীরচর ও পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক এলাকায় ঘরে ঘরে এখন কারখানা তৈরী হয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ, যার কোনো হিসাব নেই। আবার রাজধানীর আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা গ্যারেজগুলোতে বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এরও কোনো হিসাব নেই। ফুটপাথের দোকানগুলোতে অগণিত লাইট জ্বলছে তারও হিসাব রাখছে না কেউ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো হচ্ছে চোরাই বিদ্যুৎ দিয়ে। আর এই বিদ্যুৎ চুরির মাধ্যমে কেউ কেউ রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন।
রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তার বাসার পাশেই একটি গ্যারেজ রয়েছে। যে গ্যারেজে প্রতি রাতে অন্তত ৫০টি অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ হয়। এই চার্জ বৈধ মিটারের বিদ্যুৎ দিয়ে হয় না। সরাসরি খুঁটি দিয়ে বিদ্যুৎসংযোগ নিয়ে সেই বিদ্যুৎ দিয়ে রিকশার ব্যাটারি চার্জ হয়।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার এক গ্যারেজ মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈধ লাইন দিয়ে চার্জ দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাড়া দেয়া যায় না। তাতে পোষাবে না। যে কারণে প্রতিটি গ্যারেজেই অবৈধ লাইন দিয়ে ব্যাটারি চার্জ হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, হাজারীবাগ, রায়েরবাগ, মানিকনগর, বাসাবো, মুগদা, খিলগাঁও, মান্ডা, নন্দিপাড়া, রামপুরা, ইসলামবাগ, ধানমন্ডি, কামরাঙ্গীরচর, সোয়ারিঘাট, বাবুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যারেজে অন্তত ২২ হাজার অটোরিকশা প্রতি রাতে চার্জ হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। রহস্যজনক কারণে কোথাও এগুলো দিনের বেলায় চার্জ দিতে দেখা যায় না।
রাজধানীর অন্যতম বিদ্যুৎ চুরির ক্ষেত্র হচ্ছে ফুটপাথ। রাজধানীর প্রতিটি ফুটপাতের দোকানগুলোয় সন্ধ্যার পরে যে লাইটগুলো জ্বলে তার প্রায় অধিকাংশই অবৈধভাবে জ্বলছে। এগুলো সরাসরি বিদ্যুতের খুঁটি দিয়ে সংযোগ দিয়ে গাছে গাছে বোড বসিয়ে চারিদিকের দোকানগুলোতে সাপ্লাই দেয়া হয়। ওগুলো জেনারেটর দিয়ে জ্বালানোর কথা বললেও জ্বলছে লাইনের বিদ্যুৎ দিয়েই।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক হকার জানান, লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরাই রাস্তায় হকার বসায়। আর এই লাইনম্যানরাই অবৈধ বিদ্যুৎসংযোগ দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, রাজধানীর প্রায় অর্ধেক এলাকায় ফুটপাথে অবৈধ বিদ্যুতের লাইন দিচ্ছে এরা দলীয় পরিচয়ে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের রয়েছে বিশাল বাহিনী। কেউ ঝামেলা করলে এলাকার চাঁদাবাজ নেতার বাহিনী সাংবাদিক আর পুলিশ দিয়ে হয়রানী করে। প্রতিবাদ করে কেউ এখন আর এসব ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: