
১৯৪৭ সালের ছয় ও সাত জুলাই শ্রীহট্ট জেলায় গণভোট হয়। শ্রীহট্ট জেলা একদিকে ছিল আসাম প্রদেশের অধীন একটি জেলা, অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পূর্ব বাংলার সাথে লাগোয়া। সুতরাং স্থির করা হয় গণভোটের মাধ্যমে জনসাধারণের মতামত নিয়ে সিলেট জেলার ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। এই গণভোটে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি একত্রে কাজ করেছিল। তাদের বিপরীতে মুসলিম লীগ।
কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির চেষ্টা ছিল মুসলিম ভোটের একটা অংশকে ভারতের পক্ষে টানতে। আর মুসলিম লীগ চাচ্ছিলো সমগ্র মুসলিম ভোট নিজেদের আয়ত্তে রাখতে। যেহেতু জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই সবাই মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দিলে এমনিতেই সিলেট চলে আসবে পাকিস্তানে। কিন্তু জনগনকে নিজের পক্ষে টানতে হলে তো কিছু মুলা ঝোলাতেই হবে সামনে৷ না হলে জনগন কিসের লোভে তাদের কথা শুনে তাদের পক্ষে ভোট দিবে?
তাই কংগ্রেস জনগনের সামনে রাখলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মুলা। তাদের স্লোগান উঠলো, “হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই”, “সোনার সিলেট ভাঙ্গব না, ভাঙ্গা বাংলায় যাব না”, “শাহজালাল ও শ্রীচৈতন্যের সিলেট ভাঙ্গব না, ভাঙ্গা বাংলায় যাব না”।
অন্যদিকে মুসলীম লীগ মুসলীম জনগনের সামনে রাখলো সাম্প্রদায়িকতার মুলা। তারা স্লোগান উঠালো , “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”, “মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান” “গুলিসে লেঙ্গে পাকিস্তান”, “মুসলমানের ভোট মুসলমানকে দাও”।
সিলেটের এই অবস্থা হওয়ার আগে অর্থাৎ এই গণভোট হওয়ার আগে বাংলার মুসলীম লীগ নেতাদের ধারণা ছিল অখন্ড বাংলা পাকিস্তানে যুক্ত হবে। কিন্তু যখন তাদের সাথে বিন্দুমাত্র আলোচনা না করে কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হল বাংলা এবং পাঞ্জাবকে ভাগ হয়ে দুই দেশে যোগ দিতে হবে, তখন বাংলাদেশের মুসলীম লীগ নেতাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সেই সময় বাংলার মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দীর একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে রাজনীতির মাঠে পাকিস্তানের দাবীতে সোচ্চার ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। এই বিষয়ে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন,
"১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হল ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে।…………. মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল। আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম। আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফর্মুলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা। আজ দেখা যাচ্ছে, মাত্র আসামের এক জেলা তাও যদি গণভোটে জয়লাভ করতে পারি। আর বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। এই সময় শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাঁদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি না? বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এক ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে, যতদূর আমার মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্থান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। যদি দেখা যায় যে, গণপরিষদের বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি পাকিস্তানে যোগদানে পক্ষপাতী, তবে বাংলাদেশ পুরাপুরিভাবে পাকিস্তানে যোগদান করবে। আর যদি দেখা যায় বেশি সংখ্যক লোক ভারতবর্ষে থাকতে চায়, তবে বাংলাদেশ ভারতবর্ষে যোগ দেবে। যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাও থাকতে পারবে।"
বলাই বাহুল্য এই প্রস্তাব কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আমলে নেন নাই। বঙ্গবন্ধু অবশ্য লিখেছেন তাদের প্রস্তাবে জিন্না রাজি ছিল, কিন্তু কংগ্রেস বিশেষ করে কংগ্রেসের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল রাজি হন নাই। কিন্তু এই তথ্য সঠিক নয়। বাংলাকে অখন্ড রাখার ইচ্ছা শুধু জিন্নাহরই না কেন্দ্র এবং বাংলার অনেক মুসলিম লীগ নেতারও ছিল না। পাকিস্তানের সাথে গিয়ে বাংলা যে দূর্ভোগে পড়তে যাচ্ছে যা সম্ভব বঙ্গবন্ধু সেই সময়েই ব্যাপারটা প্রথম হাল্কা পাতলা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে অখন্ড রাখতে, ঠিক দুই দিন আগেও যারা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন, অর্থাৎ মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী ও হাশিম সাহেব এবং কংগ্রেসের শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায়, রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে বাংলার স্বার্থে একসাথে বসে শেষ চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেন নি।
ইতিহাসের কি নির্মম খেলা। সিলেটে সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পাকিস্তানের পক্ষে গেলেও বাংলাদেশের মুসলিম লীগের কর্মীরা মনে প্রানে চাচ্ছিলেন বাংলা ভাগ না হোক, কিন্তু কেন্দ্রের চাপে বাধ্য হচ্ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে অর্থাৎ বাংলা ভাগের পক্ষে প্রচার চালাতে৷ তাদের মনের স্লোগানগুলো দিচ্ছিলো তাদেরই বিরোধী দল কংগ্রেস।
"সোনার সিলেট ভাঙ্গব না, ভাঙ্গা বাংলায় যাব না”, “শাহজালাল ও শ্রীচৈতন্যের সিলেট ভাঙ্গব না, ভাঙ্গা বাংলায় যাব না”।
এবার একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের উপর দৃষ্টিপাত করতে চাই। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও কিছু ব্যাপারে এর চমৎকার প্রাসঙ্গিকতা আছে।
প্রাক্তন বিপ্লববাদী সংগঠনের সদস্য এবং পরবর্তীকালে শ্রীহট্টের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শ্রী চঞ্চলকুমার শর্মা সেই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছিলেন। তিনি তার লিখা "শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন স্মৃতিকথা"-- বইতে (পৃঃ২১৬-২১৯) উল্লেখ করেন, 'আমরা যখন শ্লোগান দিতাম, “হিন্দু মুসলিম ভাই-ভাই” তখন তারা ঠাট্টা করে শ্লোগান দিতেন “এসো দুইয়ে মিলে গরু খাই”।'
যদিও চঞ্চলকুমার শর্মাদের “হিন্দু মুসলিম ভাই-ভাই” স্লোগান দেয়ার পেছনে অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করার চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করাটাই মূখ্য ছিল। কিন্তু তারপরও চিন্তা করলে অবাক লাগে, কি অদ্ভুত মিল। আজকে যখন আমরা অর্থাৎ যারা অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বলি ধর্ম যার যার উৎসব সবার, তখন কিছু মানুষ কিন্তু বলে ওঠেন, তাহলে হিন্দুরাও আসুক আমাদের কোরবানি ঈদের উৎসব পালন করতে একসাথে৷ সেই ১৯৪৭ সালের সিলেটে মুসলীম লীগের জবাবে দেয়া “এসো দুইয়ে মিলে গরু খাই” স্লোগানটিও কিন্তু একই মর্মার্থ বহন করে। সাথে সাথে এই মর্মার্থ আমাদেরকে এই ইঙ্গিতও দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বীজ কতটা গভীরে রোপিত হয়েছিল আমাদেরই হাত ধরে।
নাজমুল হক ভূইয়া'র
প্রাবন্ধিক দৃষ্টিপাত
Daily J.B 24 / নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: