• ঢাকা
  • শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ; ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

ঢাকা  শুক্রবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ;   ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

গুম ছাত্রদল কর্মীর হদিস ১২ বছর পর, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হয়রানির দায় নেবে কে?


Daily J.B 24 ; প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ০৭ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৭:১৫ পিএম
গুম, ছাত্রদল, কর্মী, হদিস, বছর, আওয়ামী লীগ, নেতা, কর্মী, হয়রানি, দায়, কে

ছেলে গুম হয়েছে মর্মে পিতার মামলায় দুঃসহ জীবন-যাপন করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কারাগার, আদালতের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন তারা, ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে তাদের। রাজনৈতিক কারণে এত হয়রানির শিকার হওয়া সেই পরিবারগুলো কি পাবেন ক্ষতিপূরণ?

এক যুগ আগে জুয়া খেলে বড় অংকের অর্থ এবং মোবাইল ফোন খুইয়ে অভিমানে আত্মগোপনে চলে যান ছাত্রদল কর্মী সুমন (৩৫)। রাজনৈতিক কারণে “গুম” করা হয়েছে দাবি করে তার বাবা বিএনপি নেতা মো. মোজাফ্ফর প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং পরে মামলা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সমর্থক এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সুমনের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। সুমনের বাবা এলাকায় রটিয়েছেন, তার ছেলেকে আওয়ামী লীগের লোকজন অপহরণ এবং হত্যা করে লাশ গুম করেছে।

এদিকে সুমনকে না পাওয়া গেলেও সেই মামলার তদন্ত থেমে থাকেনি। তদন্তের দায়িত্ব থানা, ডিবি, সিআইডির হাত ঘুরে আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। পিবিআই সুমনকে খুঁজে বের করার অভিযান অব্যাহত রাখে।

অবশেষে দীর্ঘদিন পর সেই নিখোঁজ ছাত্রদল কর্মী সুমনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সোমবার (২৩শে মে) সন্ধ্যায় ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলমের তদারকিতে ঢাকার কদমতলী থানাধীন মদিনাবাগ এলাকা থেকে সুমনকে উদ্ধার করে। মঙ্গলবার (২৪শে মে) দুপুরে ঢাকার আগারগাঁও ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গুম হওয়া সুমনকে উদ্ধারের কথা জানান বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম।

জানা যায়, মিরপুর থানা ছাত্রদলের কর্মী সুমন ২০১০ সালের ৩১শে আগস্টে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকায় কয়েকজন মাদকাসক্ত বন্ধুর সাথে জুয়ার আসরে বসেন। সেই জুয়ায় বেশ কিছু টাকা হেরে যান সুমন। সঙ্গে নগদ টাকা না থাকায় জুয়াড়িরা তার দামি মোবাইল ফোনটি রেখে দেয়। একইসাথে বড় অঙ্কের দেনার দায় চাপে কাঁধে।

দামি মোবাইল ফোন এবং টাকা খুইয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আর বাড়ি ফেরেননি ২৩ বছরের যুবক সুমন। এদিকে জুয়ায় হেরে যাওয়া বকেয়া টাকার দায় জোগাড়ের চিন্তা, আবার টাকা দিতে না পারলে জুয়াড়ি বন্ধুরা ক্ষতি করতে পারে। এসব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন বাড়ি যাবেন না আর। শুরু হয় তার নিরুদ্দেশ জীবন।

সেদিন বাসায় না ফিরে প্রথমে মিরপুর থেকে গুলিস্তান যান সুমন। দিন পেরিয়ে রাত পর্যন্ত গুলিস্তানে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে পরদিন সকালে সুমন বায়তুল মোকাররম মসজিদে শুয়ে থাকেন। এরপর থেকে কখনও বায়তুল মোকাররম মসজিদের বারান্দায়, কখনও বাসে আবার কখনও বা ফুটপাতে রাত কাটাতেন সুমন। পাগলের মত বেশ ধারণ করে চেয়ে-চিন্তে খেয়ে দিন কাটে তার। ভেবেছিলেন কয়েক বছর আত্মগোপনে থাকলে হয়ত পাওনা টাকার কথা ভুলে যাবে জুয়াড়িরা।

কিন্তু বায়তুল মোকাররম মসজিদে এক দয়ালু ব্যক্তি অভুক্ত সুমনকে শাহবাগের ফুলের মার্কেটে নিয়ে গিয়ে নাস্তা খাওয়ান। পরে তার মাধ্যমে টিপু নামে অপর একজন তাকে শাহবাগ এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে শুধু থাকা-খাওয়ার শর্তে কাজ দেন।

বড় অঙ্কের টাকা দেনার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন সুমন। পরিচিতদের চোখ ফাঁকি দিতে বেশভূষা বদলে ছাত্রদলের এই কমী বেছে নেন ভিন্ন জীবন। হোটেলের বাবুর্চি হারুনের সঙ্গে সুমনের বন্ধুত্ব হয়। তার সঙ্গে ভোলার লালমোহন থানার মঙ্গল শিকদার এলাকায় একাধিকবার বেড়াতে যান। পরে শাহবাগ এলাকায় বিভিন্ন চটপটির দোকানেও কাজ করেন সুমন।

দাড়ি রাখায় এবং বেশভূষা বদলে ফেলায় তাকে আর কেউ চিনত না। কখনও ফুলের মার্কেটে কাজ, বাসের হেলপার, হোটেলের বাবুর্চি, পপকর্নের ব্যবসা এবং কাঁটাবনে অ্যাকুরিয়ামের দোকানেও কাজ করেছেন সুমন। এরই মধ্যে নান্নু ওস্তাদ নামে এক বাস চালকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তার সঙ্গে তিনি বাসের সহকারীর কাজ করেন। নান্নুর হয়ে ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল ও বারডেম হাসপাতালের যাত্রী আনা-নেওয়া করতেন সুমন। বিভিন্ন দিকে কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় বেশ ভালো আয়-উপার্জন করতে থাকেন তিনি।

এক পর্যায়ে সুমন বিয়েও করেন। যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজ করার সময় জোনাকি নামের ইউসেপ স্কুলের এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয় সুমনের। সেই সুবাদে তাদের বাসাতেও তার যাতায়াত ছিল। একপর্যায়ে জোনাকির মা জোসনার সঙ্গেও তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন আপত্তিকর অবস্থায় জোসনার স্বামী বকুল মোল্লার হাতে ধরা পড়েন ছাত্রদল কর্মী সুমন।

মেয়ে এবং স্ত্রীর সাথে প্রেম- এমন কাণ্ড দেখে জোসনাকে তালাক দেন বকুল। পরে সুমন প্রায় ৩ বছর আগে লালবাগ কাজী অফিসে গিয়ে জোসনাকে বিয়ে করেন। জোসনার মেয়ে জোনাকিকেও রাখেন বাসায়। এদিকে হাবিবুল্লাহ (৩ মাস) তাদের একটি ছেলেও রয়েছে। স্ত্রীকে নিয়ে রায়েরবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে আসছিলেন সুমন।

এদিকে সুমন দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি না ফেরায় নিরুদ্দেশ হওয়ার কিছুদিন পর তার বাবা বিএনপি নেতা মোজাফ্ফর পল্লবী থানায় জিডি করেন। দলীয় নির্দেশে মোজাফ্ফর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত মো. সুলায়মান হোসেন (২৮), শাওন পারভেজ (১৮), মো. রুবেল (২০), সোহাগ (২০) ও মানিক (২৫) নামে কয়েকজন তরুণ রাজনৈতিক কারণে তার ছেলে সুমনকে রাস্তা থেকে অপহরণ করেছে মর্মে অভিযোগ দেন থানায়। ২০১০ সালের ২৯শে অক্টোবর মোজাফ্ফর পল্লবী থানায় উল্লেখিত ব্যক্তিদের আসামি করে একটি অপহরণের মামলা দায়ের করেন।

এরপর থেকেই বিএনপি এবং তাদের অঙ্গ সংগঠন থেকে দলের কর্মী সুমনের নিরুদ্দেশ ও গুম হওয়া নিয়ে নানারকম গুজব এবং অপপ্রচার চালাতে থাকে। তার ছবি এবং দলীয় পরিচয় উল্লেখ করে বেশ কিছু নামসর্বস্ব ভুঁইফোড় তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমেও সরকারবিরোধী অপপ্রচারে এসব মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করেছে বিএনপি।

যে সময় সুমন সবার নাকের ডগায় বসে আছেন, মা-মেয়ের সাথে একইসাথে চুটিয়ে প্রেম করছেন, সেই একই সময় তার বাবার করা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সেই কর্মী ও সমর্থকরা। মামলায় মামলায় জর্জরিত হয়ে যায় তাদের পারিবারিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবন। পাড়া-প্রতিবেশির সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এমনকি সেই মামলার পেছনে বিস্তর অর্থ খরচ করে সুমনের বাবা মোজাফ্ফর। এক পর্যায়ে আসামিসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে আদালতে তোলা হয়। যদিও পরে তদন্তে দেখা যায়, তারা কেউই সুমন নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে জড়িত নয়। তবুও বিভিন্ন তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক চাপে তদন্ত চালিয়ে যায় থানা এবং ডিবি। সিআইডিও সুমনের কোনো হদিস বের করতে পারেনি। তবে মামলার বাদী সুমনের বাবা বারবার আদালতে নারাজি দেওয়ায় তদন্ত অব্যাহত থাকে।

আদালত ২০১৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেন। পিবিআই'র পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। একপর্যায়ে, সুমনের অবস্থান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যতে তাকে উদ্ধার সংক্রান্ত কোনো সূত্র বা তথ্য পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে- উল্লেখ করে তারাও মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে।

একপর্যায়ে সোর্স মারফত গতকাল সোমবার সুমনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পান মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। আদালতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আবেদন করেন। এরপর ওইদিনই সন্ধ্যায় ঢাকার কদমতলী থানার মদিনাবাগ এলাকা থেকে সুমনকে উদ্ধার করে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসা হয়। আজ সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় ছাত্রদল কর্মী সুমনকে।

গুম সুমনের বাবার দায়েরকৃত মামলায় সুলায়মান নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মী এবং ব্যবসায়ীকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। তার ব্যবসায় লালবাতি জ্বলেছে বহুদিন আগেই। হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত। সুমনকে উদ্ধার করায় এই মামলায় সব আসামিই নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুমনের বাবা এবং বিএনপির এই মামলাকাণ্ডে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাদের ক্ষতিপূরণের দায় কার?

Daily J.B 24 / News Desk

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ