
গত ৩০ বছরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কারণ অনুসন্ধান, ঘটনার কুশিলবদের চিহ্নিতকরণ এবং ভুক্তভোগীদের বিবরণ সহ সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয় নির্দেশ করার উদ্দেশ্যে মোট ৭টি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। এগুলো হচ্ছে-
সুতরাং বর্তমান গণকমিশন কর্তৃক প্রকাশিত, "বাংলাদেশ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন" শ্বেতপত্রটি হুট করে উদয় হওয়া কোনো বস্তু তো নয়ই এমনকি একে "তথাকথিত" বা "ভূঁইফোড়" বলে উড়িয়ে দেয়ারও কোনো অবকাশ নেই। কারও কাছে যদি "শ্বেতপত্র" নতুন মনে হয় সেটা তার সীমিত জ্ঞানের কারনে সৃষ্ট ব্যার্থতা।
২০২১ সালের ২২ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে এই গণকমিশন গঠন করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য এতে মূল চুলকানী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামেই শুরু হয়েছে। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্র ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি তুলে ধরেছিল তাদের পূর্বের শ্বেতপত্রে- ভুলে গেলে চলবে না তাতে আখেরে ক্ষতিটা কাদের হয়েছিল।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি/জামাতের চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ের উপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন আরম্ভ করেছিল তা চলমান ছিল দীর্ঘ ১৫০০ দিন পর্যন্ত। এই ১৫০০ দিনের বিস্তারিত হিসাব লিপিবদ্ধ করে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির পক্ষ থেকে শাহরিয়ার কবিরের সম্পাদনায় যে তিন খন্ডের শ্বেতপত্র বের হয়েছিল তাতে বিএনপি/জামাত জোটের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা এবং জঙ্গী তোষণের বিস্তারিত আমলনামা প্রমানসহ তুলে ধরা হয়েছিল। এতে দেশে-বিদেশে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহল বিএনপি/জামাতের পৈশাচিক চেহারাটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল হাড়ে হাড়ে। বিএনপি/জামাতের পক্ষ থেকে সেই শ্বেতপত্রকে "ভিত্তিহীন", ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং নাস্তিক-মুরতাদ (তথাকথিত) কর্তৃক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের পায়তারা হিসেবে অপপ্রচার করা হয়েছিল।
[এর উপর শাহরিয়ার কবিরের একটা ডকুমেন্টারী ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায়।]
বর্তমানে প্রকাশিত শ্বেতপত্র নিয়েও একই ধাচের কথা বলা হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টা হচ্ছে এইবার এই প্রপাগান্ডায় গলা মিলাচ্ছে কিছু সংখ্যক আওয়ামী রাজনীতি করা মানুষজন। একজন হে-জা-বি (হেফাজত/জামাত/বিএনপি) করা কর্মী/নেতা/সমর্থকের চোখে- গনকমিশন, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি বা শাহরিয়ার কবিরদের মত মানুষরা নাস্তিক-মুরতাদ (তথাকথিত) হতে পারেন কিন্তু একজন আওয়ামী-ছাত্র বা যুবলীগের কর্মী/সমর্থকও তাদেরকে নাস্তিক-মুরতাদ বা ইসলাম বিদ্বেষী মনে করার কারনটা আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না। আপনারা কি ভুলে গেছেন বা জানেন না ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি জন্ম থেকে কাদের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছে? শহীদ জননী জাহানারা ইমামের হাতে গড়া এই সংগঠনের নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের ফসল আজকের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যাকে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা বিশাল অর্জন হিসেবেই গণ্য করা হয়।
প্রকাশিত শ্বেতপত্রে যে ৩৫ জনের তালিকা নিয়ে জল ঘোলা করা হচ্ছে সেটা পুরো রিপোর্টের অতি অতি এবং অতি ক্ষুদ্র একটা বিষয়ের প্রেক্ষাপটে দেয়া হয়েছে। পুরো রিপোর্টটা আরও বিশাল এবং বিস্তৃত। আপনারা এই ৩৫জন মানেই যদি সারা বাংলাদেশের আলেম সমাজকে ধরে বসে থাকেন এবং হেজাবিদের মত বলতে শুরু করেন, "বর্তমান সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আলেম সমাজ ও সরকারকে একে অন্যের প্রতিপক্ষ বানানোটা গনকমিশনের উদ্দেশ্য কি না সেটা খতিয়ে দেখা উচিত"- তাহলে বলতে হয় রাজনীতির নামে আপনারা এতদিন কেবল লীগের অমুক নেতা-তমুক ভাইয়ের পশ্চাৎদেশই চেটে কাটিয়েছেন, কাজের কাজ কিছুই করতে পারেন নি।
গনকমিশনের রিপোর্টে ৩৫ জনের তালিকা আপনাদের চোখে পড়েছে কিন্তু এতে আরও কত জনের কত তালিকা যে আছে সে বিষয়ে হয়ত আপনারা জানেনও না উল্টো জানতে চাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টিতেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
শ্বেতপত্রে দেশী জঙ্গী সংগঠনগুলো ছাড়াও আছে রহিঙ্গাদের ৪০টি জঙ্গী সংগঠনের তালিকা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০০০ রহিঙ্গার জবানবন্দি। আছে জঙ্গী ভাববধারার সংগঠনগুলোর আধুনিক কর্মকান্ড যা সাইবার জিহাদ নামে পরিচিত তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা। হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জঙ্গী হামলার তালিকাসহ এতে জড়িতদের ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ননা। আর যদি একান্তই পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হয় সেক্ষেত্রেও বলা যায় টার্গেট হেজাবি। ইসলাম বা আলেম সমাজ নন। এখন আলেম সমাজ যদি গায়ের জোরে হেজাবি'দের সমকাতারে আসতে চায় তাহলে আর বলার কিছু নাই।
বর্তমান শ্বেতপত্রে হেফাজতে ইসলামের মোট ৭৬ জন কমিটি নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে। এই নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে যে, তাদের অনেকেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী'র সঙ্গে যুক্ত। বেশির ভাগ হেফাজতে ইসলামের নেতাই নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলাম আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি, ইসলামী জনকল্যাণ পরিষদ ইত্যাদি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। অনেকে আবার তালেবান ও আল কায়দার সঙ্গে আফগান জিহাদে অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের আস্থাভাজন ও মুরব্বী ছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এছাড়া হেফাজতে ইসলামের বেশির ভাগ নেতাই মুক্তিযুদ্ধকালে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠনে সহযোগিতা করেছেন এবং নিজেরাও এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান শ্বেতপত্রে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কার্যক্রম, হেফাজতের মামলার হালচাল, হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভ, হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন (২০২০), হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যু, বিভিন্ন সময়ে হেফাজতের তাণ্ডব, হেফাজত নেতাদের রাজনৈতিক পরিচিতি তুলে করা হয়েছে।
সুতরাং গনকমিশন, শ্বেতপত্র এবং ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির উল্লেখে কাদের চুলকানী কেন উঠবে সেটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যার চুলকানী তাকেই চুলকাইতে দেয়া উচিৎ।
#শ্বেতপত্র
#একাত্তরের_ঘাতক_দালাল_নির্মূল_কমিটি
Daily J.B 24 / জয় বাংলা২৪ নিউজ ডেস্ক
আপনার মতামত লিখুন: